উঠানে রোমিও-জুলিয়েট

ভানু সুন্দরীর পালা নাটকের দৃশ্য
ভানু সুন্দরীর পালা নাটকের দৃশ্য

বলে কী! উঠানে হবে নাটক? তাও আবার রোমিও–জুলিয়েট। শেক্​সপিয়ারের ট্র্যাজেডি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চাকদহ জেলার নাট্যকর্মীদের মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু নাটক দেখার পরে মুগ্ধ তাঁরা। মেনেও নিলেন, বাড়ির আঙিনায় শেক্​সপিয়ারের ট্র্যাজেডি মঞ্চায়ন করা যায়, করা যায় উপভোগও।

পশ্চিমবঙ্গের চাকদহের সঙ্গে বাংলাদেশের কী সম্পর্ক? এ প্রশ্ন এসে যায় খানিকটা। তাদের বলা। এই নাটকের কুশীলবেরা পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চাকদহ এলাকার। নাটকটি রূপান্তর ও নির্দেশনার কাজটি করেছেন বাংলাদেশের তরুণ নির্দেশক ও পালাকার সায়িক সিদ্দিকী। শুধু তা–ই নয়, ইংল্যান্ডের রোমিও–জুলিয়েটরা আসেননি সে সন্ধ্যায় চাকদহ এলাকার উঠানঘরে। সেখানে এসেছিলেন রোমিও–জুলিয়েটরই ছায়া বাংলার চন্দ্র ও ভানু সুন্দরী। বাংলার পালানাট্যের আঙ্গিকে শেক্​সপিয়ারকে সে সন্ধ্যায় হাজির করার কৃতিত্বটুকু তরুণ সায়িকের।

ভারতের মাটিতে দেশি পালা মঞ্চায়ন। সে নাটক পেরোল ৫০টি রজনী। এটা কেবল একটি খবর নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু—এমনটি মনে করেন এই তরুণ নির্দেশক। কারণ, পালা নির্দেশনায় এতটুকু ছাড় দেননি তিনি। ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ আর নেত্রকোনার পালাকাররা যে ভাষায়, যে গাঁথুনিতে, যে ঢঙে, যে আঙ্গিকে পালা করেন, সেভাবেই উপস্থাপনা করেছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে বাংলাদেশের বাংলার উচ্চারণের যে নরম পার্থক্য আছে, ওইটুকুও ছাড় দেননি তিনি। চাকদহের নাট্যশিল্পীদের কর্মশালা করিয়ে আত্মস্থ করিয়েছেন নেত্রকোনা অঞ্চলের
ভাষার টান।

শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? সায়িকের বক্তব্য, ‘নদীয়া জেলার চাকদহের নতুন একটি নাট্যদল চাকদহ নাট্যজন। ওখানে একটি উৎসব হয় গত বছর। সেখানে আমি গুনজান বিবির পালা নাটকটি নিয়ে যাই। পদাতিক নাট্য সংসদ টিএসসি এটি প্রযোজনা করে। ওই দলের সঙ্গে নির্দেশক হিসেবে আমিও যাই। ওরা পালা দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠে পালা করার জন্য।’

দেশি পালা নিয়ে নদীয়ার একটি নাটকের দলের আগ্রহের শুরুটা এখানে। তারপরের গল্পটা শুনে নিই চাকদহ নাট্যজনের সম্পাদক সুমন পালের মুখে। নাটকটির ব্রুশিয়ারে তিনি লিখেছেন, ‘এক ডিসেম্বরে সায়িক সিদ্দিকী ও তার পালা গুনজান বিবির সঙ্গে দেখা ও প্রেমে পড়া। আমরা সেই সময় একদমই নবীন একটি দল। একবুক ইচ্ছে ও একদল নতুন যৌবনের ছেলেমেয়ে। শুধু এটুকুকে ভরসা করেই সায়িক সিদ্দিকীকে আমরা আহ্বান জানিয়েছিলাম। তিনি এলেন এবং আমাদের মন জয় করলেন। আমরা টানা ২৩ দিনের পরিশ্রমে জন্ম দিলাম ভানু সুন্দরীর পালা।’

তিনি এ কথাটিও উল্লেখ করেন, বিশেষত্ব এটাই এই প্রথম বাংলাদেশের পালাকার ও নির্দেশকের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় কিছু অভিনেতা–অভিনেত্রী ইংল্যান্ডের শেক্​সপিয়ারের রোমিও–জুলিয়েটকে পালানাট্যে মঞ্চে নিয়ে আসা। এভাবেই শুরু হলো নদীয়াতে ভানু সুন্দরীর পালা নাটকের কাজ। একেবারে নতুন ছেলেমেয়ে। সায়িক তাই আয়োজন করলেন পালা নিয়ে একটি কর্মশালার। তারপর দিনরাত পরিশ্রম। নদীয়ার চাকদহের সম্প্রীতি মঞ্চে প্রথম মঞ্চায়ন হয়, ২৬ মার্চ, গত বছর। আর পঞ্চাশতম মঞ্চায়ন হলো, আকাদেমি অব ফাইন আর্টস কলকাতায়, গত ৯ জুন। প্রথম মঞ্চায়নের পরে নাটকটি আয়োজন করা হয়েছিল নদীয়ার একটি গ্রামের উঠানে। সেখানে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আবহের বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদে নাটক উপভোগ করলেন দর্শকেরা। সায়িকের ভাষায়, ‘পালাকারেরা সন্ধ্যায় একেবারে খোলা মাঠে যে পালা গায়, তারই স্বাদ দিতে করেছিলাম এই আয়োজন।’ দর্শকেরাও গ্রহণ করলেন উৎসাহভরে প্রতিটি প্রদর্শনী। সেই প্রশংসাও স্থান পেয়েছে নাটকটির পুস্তিকায়। নাট্যকর্মী ও একজন দর্শক গীতশ্রী সরকার লিখলেন, ‘বাড়িতে এসে স্বভাবতই কাজ কম, তাই “খই ভাজছিলাম”। এমন এক সময় বন্ধু শৈলীর ডাকে সাড়া দিয়ে পৌঁছালাম মালদা অডিটরিয়ামে নাটক দেখতে। রোববার মঞ্চে একটা নতুন সমন্বয়ে আখ্যান গড়ে উঠতে দেখলাম। রোমিও কখন চন্দ্র আর জুলিয়েট কখন যে ভানু হয়ে গেল অবলীলায়, বুঝতেই পারিনি। ক্ল্যাসিকাল আর ফোক মিশে গেল, নারী আর পুরুষ মিশে গেল অবলীলায়। নতুন প্রজন্ম, নতুন ধারা, সংস্কৃতির সমন্বয়, বাঁধ ভাঙা বেশ তো...’।