কীভাবে বাছাই হয় অভিনয়শিল্পী

সালাহউদ্দিন লাভলুর লার্নেড ম্যান নাটকে আ খ ম হাসান ও জাহিদ হাসান। দুজনেরই অভিনয়ের শুরু মঞ্চনাটক দিয়ে। ফাইল ছবি
সালাহউদ্দিন লাভলুর লার্নেড ম্যান নাটকে আ খ ম হাসান ও জাহিদ হাসান। দুজনেরই অভিনয়ের শুরু মঞ্চনাটক দিয়ে। ফাইল ছবি

একটা সময় ছিল যখন পরিচালকেরা অভিনয়শিল্পী খোঁজার জন্য বেইলি রোডে আড্ডা দিতেন। গাইড হাউস কিংবা মহিলা সমিতি মিলনায়তনে বিভিন্ন দলের নাটক দেখতেন। মঞ্চের কোন পাত্র-পাত্রী তাঁর অভিনয়ে চমকে দিচ্ছেন, তাঁকে তুলে আনতেন টেলিভিশন নাটকে। এখন অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপনচিত্র কিংবা পত্রপত্রিকার পাতায় প্রকাশিত সুন্দর মুখশ্রীর কাউকে খুঁজে নেন অনেক পরিচালক। শিল্পী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইনস্টাগ্রামসহ অন্য সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার অনুসারী কত—এই ভাবনাও কাজ করে।

কেউ বলছেন, পাত্র-পাত্রী যেকোনো মাধ্যম থেকে বাছাই হতে পারে। তবে বাছাইয়ের পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে নিতে পারলে ভালো হয়। তা না হলে নাটকের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির পাশাপাশি ওই শিল্পীর স্থায়িত্বও কমে।

টেলিভিশন নাটকে বর্তমানে যারা অভিনয় করছেন, তাঁদের অনেকেরই মঞ্চে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। বিজ্ঞাপনচিত্রে জনপ্রিয় এমন অনেকেই নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেন। এমনও শোনা যায়, আচ্ছা ওর তো ফেসবুকে ফ্যান-ফলোয়ার বেশি, তাঁকে নিয়ে নাটক বানালে তো নিশ্চিত লাখ ভিউ হবে—তাই অনেকে সেই পথেও হাঁটেন।

পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বল বলেন, ‘নাটকে করপোরেট বিনিয়োগ বাড়ার সঙ্গে মঞ্চের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিল্পী বাছাইয়ের ধরন বদলে যেতে থাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত টেলিভিশন চ্যানেলের কারণে কাজের সংখ্যা এবং চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এর জোগান দিতে গিয়ে অভিনয়ের ন্যূনতম শিক্ষা না থাকা শিল্পীদের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে তো ওয়েবভিত্তিক প্ল্যাটফর্মের উত্থানে কাজের চাহিদা সীমাহীন। শিল্পীর তুলনায় নির্মাতার সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি! ফলে কাজের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে আমরা ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছি।’

শুধু থিয়েটার অভিজ্ঞতা থাকলেই একজন শিল্পীর কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত অভিনয় পাওয়া যাবে এমনটাও মনে করছেন না অনেকে। মঞ্চ, টিভি নাটক বা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ধরনও এক নয়। মঞ্চের অভিনয়শিল্পীর সুবিধা হলো তিনি অভিনয়ের পদ্ধতি ভালো জানেন। কিন্তু পদ্ধতি জানলেই হবে না, ভিন্ন মাধ্যমে সেটির প্রয়োগে ভিন্নতা থাকতে হবে। তা না হলে শিল্পী যদি চরিত্রের চাহিদা না বুঝে গৎবাঁধা অভিনয় করেন, সে চরিত্র ব্যর্থ হবে। দিন শেষে এটি মনে রাখতে হবে অভিনয়টা হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা—এমনটাই মনে করা হয়।

অপূর্ব ও নিশো দুজনেই নাটকে অভিনয় শুরু করেন গাজী রাকায়েতের পরিচালনায়। ঘরছাড়ায় অপূর্ব ও বৈবাহিক নাটকে আফরান নিশো। এই পরিচালক বলেন, ‘বাইরের দেশে নাটক কিংবা কাস্টিং ডিরেক্টর বা কাস্টিং এজেন্সি বলে প্রতিষ্ঠান থাকে। সেখান থেকে চরিত্রের উপযোগী অভিনয়শিল্পী বাছাই করা যায়, হোক নতুন কিংবা পুরোনো। আমাদের দেশে শুধু বিজ্ঞাপনচিত্রে এই প্রচলন আছে। যেকোনো মাধ্যম থেকে নাটকের পাত্র-পাত্রী বাছাই করা যেতে পারে। নতুন হলে তাঁদের নিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রশিক্ষণ করিয়ে নিলে ভালো হয়। যেমনটা আমি অপূর্ব ও নিশোর ক্ষেত্রে করেছিলাম।’

মঞ্চের অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু টেলিভিশন নাটকে ব্যস্ত শবনম ফারিয়া, মেহজাবীন, তানজিন তিশা, ইরফান সাজ্জাদ প্রমুখ। এই অভিনয়শিল্পীদের বেশির ভাগই এসেছেন বিজ্ঞাপনচিত্র কিংবা গানের মডেল হিসেবে। অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি ও পরিচালক শহীদুজ্জামান সেলিম মনে করেন, চিত্রনাট্যের যে চরিত্রে যাকে মানায়, তাঁকেই নির্বাচন করেন। হতে পারে মঞ্চের নতুন একজন অভিনয়শিল্পী কিংবা অনেক পুরোনো। এমনকি টেলিভিশন বা মঞ্চ কোনোটাই করেননি—এমন একজন নবাগত তরুণ-তরুণী হতে পারেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসারী দেখে অভিনয়শিল্পী বাছাইয়ের বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত শহীদুজ্জামান সেলিম। দেশে পর্যাপ্ত দক্ষ অভিনয়শিল্পী থাকা সত্ত্বেও এমন সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন তিনি।

নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলছেন, মঞ্চে আগের মতো অভিনয়শিল্পীও পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, ‘ভালো নাটক বানাতে চান এমন পরিচালকেরা এখনো মঞ্চপাড়ায় আসেন। আমরা তো মঞ্চে আগের মতো সেই অবস্থা তৈরি করতে পারছি না। আগে যেমন ঝাঁকে ঝাঁকে শিল্পী পেতাম, এখন সেই সুযোগটা নেই। যেখান থেকে পাত্র-পাত্রী বাছাই করা হোক, অডিশন করে নিলে হয়। হলিউড ও বলিউডে নতুনদের ক্ষেত্রে অডিশন সিস্টেম চালু আছে। এখন আবার পরিচালকেরা সময়ও পায় না। টাকাপয়সাও কম। আবার চ্যানেলগুলো ঠিক করে অমুককে নেন, তমুককে নেন। যারা বলে দেয়, তারা খুব নিম্ন রুচির মানুষ। এ কারণে নাটক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’