ঢাকার নাট্যাঙ্গনে বর্ষায় বসন্তের রং

রং লেগেছে নাটকের দৃশ্য
রং লেগেছে নাটকের দৃশ্য

‘সকালের মিষ্টি রোদে ভালো থাকে শরীর, সন্ধ্যার পরে নাটকের ওমে ভালো থাকে মন।’ শীতকালে নাট্যাঙ্গন নিয়ে এমনটাই বলে থাকেন বিদগ্ধজনেরা। কিন্তু এখন বর্ষাকাল। এই সময়ে এসে সকালের রোদের ভাবনটা বাড়াবাড়ি বটে। তবে সন্ধ্যার নাটকের জমজমাট আয়োজন মোটেও এড়িয়ে যাওয়ার মতো না। অন্তত গেল সপ্তাহের চিত্রটা এমন ধারণাই দিচ্ছে।  

গত শুক্রবারের কথাই বলি। সেদিন দুপুর থেকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। সন্ধ্যায় আকাশের মন ভার, পথঘাট ভেজা। এর মধ্যে রাজধানীর সেগুনবাগিচার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গিয়ে দেখা গেল, রীতিমতো উৎসবমুখর চারদিক। বাইরে টিকিট কাউন্টারের সামনে নাট্যানুরাগী দর্শকের দারুণ উপস্থিতি। মেঘ–বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাঁরা এসেছেন। এক সন্ধ্যায় দুই মঞ্চে দুটি নতুন নাটকের উদ্বোধন হয়েছে সেদিন। জাতীয় নাট্যশালায় ইউনিভার্সেল থিয়েটারের রেনুলতা, স্টুডিও থিয়েটারে পালাকার নাট্যদলের রং লেগেছে। একই দিনে দুটি নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছে অনেক দর্শকের। কেননা, প্রদর্শনীর সূচি ছিল এমনই, আগে–পরে। 

 দুই নাটকের তিনটি পরিবেশনা ছিল। এক দিনে দুটি নতুন নাটক আর নাটক দেখতে আসা দর্শকের আগ্রহ দেখে মনে হলো, নাট্যাঙ্গনে বসন্ত উঁকি দিচ্ছে যেন। সাধারণত শীত শেষে বসন্তেই নাটকপাড়া জমে বেশি। লিখলে বাড়াবাড়ি হবে না, বর্ষা এখন এই শহরে নতুন নাটকের নতুন মৌসুম। প্রমাণ হিসেবে দুটি নাটকের উপস্থিতি, সদ্য শেষ হওয়া আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব এবং সামনে আরও কয়েকটি নাটকের আসার কথা সহজেই বলা যায়।

স্টুডিও থিয়েটারে রং লেগেছিল

গত ২৬ জুন প্রথম যে নাটকটি ঢাকার মঞ্চে নাম লেখায়, সেটি হলো রং লেগেছে। পালাকার নাট্যদলের নাটক। প্রথম বলা হচ্ছে, কেননা সেদিন নাটকটির দুটি প্রদর্শনী হয়েছিল। প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল বিকেল ৫টায়। দ্বিতীয় প্রদর্শনী সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। 

 রং লেগেছে নাটকটি প্রেম–ভালোবাসা আর হাস্যরসের মিশেল। পরপর দুই দিন নাটকটির চারটি প্রদর্শনী হয় স্টুডিও থিয়েটারে। ঢাকার মঞ্চে নতুন হলেও গল্পটি পুরোনো। ১৮৯০ সালের ২৪ ডিসেম্বর কলকাতার মঞ্চে পৌরাণিক পঞ্চ রং শিরোনামে নাটকটি প্রথম
মঞ্চস্থ করে কমেডি নাট্যদল দ্য রয়েল বেঙ্গল থিয়েটার। সেই মঞ্চায়নের ঘটনাটির ১৩০ বছর পর নতুন রূপে নাটকটি মঞ্চে এনেছে পালাকার। নাটকটির নাট্য নবায়নের পাশাপাশি পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় রয়েছেন আমিনুর রহমান। 

প্রযোজনাটি প্রসঙ্গে আমিনুর রহমান জানান, পালাকার দীর্ঘদিন ধরে নতুন সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য স্টুডিওভিত্তিক নাট্য নির্মাণের প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের নির্বাচিত নাট্যধারা প্রেম ও হাস্যরস। তিনি বলেন, ‘প্রায় শতবর্ষ আগের পাণ্ডুলিপিটি হাতে পেয়ে আমি কাজ শুরু করি। আগেকার কলকাতার থিয়েটারে যেসব নাটক জনপ্রিয়তার দাপটে বারবার অভিনীত হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ইউরোপীয় ধারার রোমান্টিক কমেডি। ওই সময়ে মলিয়ের ও শেক্‌সপিয়ারের অনুবাদ নাটক অসংখ্যবার মঞ্চস্থ হয়েছে। সেই সঙ্গে একই ধারার মৌলিক নাটক সৃষ্টির প্রবণতাও আমরা লক্ষ করেছি, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই স্টুডিও প্রযোজনা রং লেগেছে।’ তিনি জানান, এই প্রযোজনায় মূল পাণ্ডুলিপিতে যতগুলো চরিত্রসংখ্যা ছিল, প্রযোজনাগত কারণে তা কিছুটা কমানো হয়েছে। ফলে স্বভাবতই পাণ্ডুলিপিতেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। পাণ্ডুলিপির মূল ভাব ঠিক রেখে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর সুরও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে।

রেনুলতা নাটকের দৃশ্য
রেনুলতা নাটকের দৃশ্য

জঙ্গিবাদবিরোধী নাটক ‘রেনুলতা’

তারুণ্যদীপ্ত দল ইউনিভার্সেল থিয়েটার। ইতিমধ্যে তাদের কিছু প্রযোজনা বিপুল প্রশংসা পেয়েছে নাট্যামোদীদের। অতীতে দেখা গেছে তাদের বেশির ভাগ নাটক ঐতিহাসিক ঘটনা বা কোনো নির্দিষ্ট বার্তা নিয়ে। শুক্রবার মঞ্চে আসা তাদের নাটকটি জঙ্গিবাদবিরোধী, নাম রেনুলতা। নাটকটি লিখেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন আবুল হোসেন। 

রেনুলতা দেখতে ভিড় করেছিলেন অনেক নাট্যামোদী। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হয় নাটক। বলা যায়, দর্শকের জন্য গল্পটি একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। সময়োপযোগী এ নাটকে যেমন ছিল প্রেম ও দাম্পত্য জীবনের কথা, তেমনই ছিল নিরবে জঙ্গিবাদ বিস্তারের ভয়াবহ চিত্র। দর্শক-শ্রোতাদের নাটকটি দেখতে দেখতে মনে পড়ছে বিগত বছরগুলোতে আলোচিত নানা জঙ্গি হামলার কথা। কী দুর্বিষহ সেই দিনগুলো!

বলা হয়, ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়’। যুগ যুগ ধরে চলে আসা অমোঘ এই বিধানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নাটকে মানুষ ও ধর্মের এক নির্মোহ বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। নাটকটির প্রধান চরিত্র রেনুলতা একজন অভিনেত্রী। নাটকের শুরুতেই দেখা যায়, এ অভিনেত্রীকে জেরা করছে গোয়েন্দা পুলিশ। জানতে চাচ্ছে ঘটনার গোপন সূত্র। তখনই স্মৃতিচারণায় উঠে আসে তার জীবন আর সংসারের মর্মান্তিক ঘটনা। উঠে আসে জঙ্গিবাদের ভয়াল রূপ। বীভৎস এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে ফেরে রেনুলতা। একদিন নাটক চলাকালে মঞ্চে আক্রমণ করে এক জঙ্গি দল। সেখানে সে দেখতে পায় তার হারিয়ে যাওয়া স্বামীকে। জঙ্গি দলে যোগ দিয়ে তার স্বামী জাহিদ হয়ে যায় জিহাদ জাঈদি। তীব্র ঘৃণায় উন্মাদ হয়ে যায় রেনুলতা। তাকেই জিম্মি করে জাহিদ। সঙ্গে নিয়ে নেয় নাটকের নির্দেশক হিমেশ চন্দ্রকে। এরপর সরকারের সঙ্গে চলতে থাকে দর-কষাকষি। একপর্যায়ে বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ হারায় সব জঙ্গি। সন্দেহভাজন হিসেবে ইন্সপেক্টর আরমানের জেরার মুখে পড়ে রেনুলতা। এভাবেই এগিয়ে যায় নাটকের কাহিনি।

নতুন নাটকের মৌসুম 

ঢাকার মঞ্চে এখন যেন নতুন নাটকের মৌসুম। ১০ জুন সাড়া জাগিয়ে মঞ্চে এল নতুন নাটক স্তালিন। কামালউদ্দিন নীলুর নির্দেশনায় স্তালিন–এর পরপর বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়। দর্শকেরও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল নাটকটির প্রতি। এর আগে ৩০ এপ্রিল লোক নাট্যদল মঞ্চে এনেছে বুদ্ধদেব বসুর গল্প অবলম্বনে লিয়াকত আলী লাকী নির্দেশিত আমরা তিনজন। ১৯ এপ্রিল নতুন নাট্যদল তাড়ুয়া মঞ্চে এনেছে রুনা কাঞ্চনের লেখা বাকার বকুল নির্দেশিত নাটক লেট মি আউট। ১৬ এপ্রিল ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে এনেছে রুমা মোদকের লেখা সামিউন জাহান নির্দেশিত ফিয়ারলেস। ২৩ মার্চ নাট্যচক্র মঞ্চে আনে দেবপ্রসাদ দেবনাথের নির্দেশনায় একা এক নারী। 

বলা হয়ে থাকে, শীতে নাট্যাঙ্গন জমে, বসন্তে সেটি চূড়ান্ত রূপ পায়। উৎসবগুলোর আয়োজনও সে সময়ে হয় বেশি। কিন্তু সাম্প্রতিক ঢাকার নাট্যাঙ্গন প্রমাণ দিচ্ছে, এখন আর শীতের অপেক্ষায় থাকতে হয় না নাট্যনুরাগীদের। শীত–বসন্ত–বর্ষা—সব সময়ই রঙিন আর মুখর ঢাকার নাট্যাঙ্গন।