ব্যান্ড ভাঙার নেপথ্য কারণ

এলআরবি, ফিডব্যাক, মাইলস ও শিরোনামহীন ব্যান্ড। ভাঙনের খবরে আছে তারাও
এলআরবি, ফিডব্যাক, মাইলস ও শিরোনামহীন ব্যান্ড। ভাঙনের খবরে আছে তারাও

শিল্পীদের আড্ডায়, শিল্পীদের কারও বাসার জমায়েতে এখন প্রায়ই গুরুত্ব পায় ব্যান্ড এলআরবির ভাঙনের খবর। বাংলাদেশের ব্যান্ডের ইতিহাসে ভাঙন নতুন ব্যাপার নয়। একেকটা ভাঙন ভক্তদের হৃদয়ে রক্ত ঝরায়। তারপরও নানা কারণে ভেঙে যায় ব্যান্ড। ব্যান্ড ভাঙার নেপথ্যে কোন বিষয়টা কাজ করে, ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত অনেকের সঙ্গে কথা বলে তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে দেশের সংগীতাঙ্গনে দাপটে বিচরণ করা গানের দল এলআরবি। সংগীতাঙ্গনে এলআরবি নিয়ে কানাঘুষা, আইয়ুব বাচ্চুর স্বপ্নের গানের দলের পথচলা কি তাহলে শেষ! আপাতদৃষ্টিতে শেষ না হলেও গানের দল এলআরবি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য স্বপন ও ২০০৬ সালে যোগ দেওয়া রোমেল চাইছেন, এলআরবি নিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর স্বপ্নের পথ পাড়ি দিতে। গিটারিস্ট মাসুদ আর ব্যবস্থাপক শামীম চাইছেন না কোনোভাবে দলটি নিয়ে আর বেশি দূর এগিয়ে যেতে, তাই সরে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা।

আইয়ুব বাচ্চু বেঁচে থাকতে তাঁর সঙ্গে মঞ্চ আলোকিত করেছেন স্বপন, মাসুদ ও রোমেল। দলের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন শামীম। দলটি ভাঙল কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে এককথায় রোমেল বলেন, ‘মতের অমিল। আমাদের খুব চমৎকার একটি বন্ডিং ছিল। বসের (আইয়ুব বাচ্চু) মৃত্যুর পর মতের অমিল তৈরি হয়। আমাদের চাওয়া ছিল, প্রতিষ্ঠিত গায়ক নন, নতুনদের মধ্যে যারা বসের গান ভালোভাবে গায়, তেমন কাউকে নিয়ে পথ চলতে। বাকি দুই সদস্য তা চাননি। এই কারণে আরও কিছু জটিলতা তৈরি হলে আলাদা হয়ে যাই।’

সংগীতজীবনের শুরুতে রিদ্ম সেভেনটি সেভেন ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ। নানা কারণে দল ছেড়ে এককভাবে সংগীতের পথে পা বাড়িয়েছেন বলে জানান তিনি। ব্যান্ড ভাঙার কারণ তিনি ব্যাখা করলেন এভাবে, ‘তরুণ সময়ে যারা ব্যান্ড গড়ে, তাদের কেউ কেউ উচ্চশিক্ষার কারণে সময় দিতে পারে না। এতে অন্যরা মনোবল হারায়। প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডের ক্ষেত্রে ভোকালের চেয়ে অন্য সদস্যদের পিছিয়ে থাকা নিয়েও নিজেদের মধ্যে ঈর্ষা তৈরি হয়। আমরা দেখি, ব্যান্ডে ভোকাল প্রায়ই তাঁর ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেন। এ–ও দেখি, কখনো দলনেতা ব্যান্ড নিয়ে মঞ্চে ওঠেন। কখনো “উইথ ফ্রেন্ডস” এবং কখনো এককভাবে অন্য মিউজিশিয়ান নিয়েও শো করেন। অথচ ব্যান্ডের অন্য সদস্যরা দলের বাইরে কিছু করতে গেলে বাধা দেন দলনেতা। শুধু তা–ই নয়, অন্য মিউজিশিয়ানরা তাঁদের যোগ্যতা মঞ্চে দেখাতে চাইলে ঠিকমতো সুযোগ দেওয়া হয় না—মনে একটা চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়।’

>

ভোকালের অন্য সদস্যদের ওপর হস্তক্ষেপও ব্যান্ড ভাঙার অন্যতম কারণ।
সদস্যদের মধ্যে ঈর্ষা গড়ে উঠলেও ব্যান্ডে ভাঙন ধরে।
শোর সম্মানীর সুষম বণ্টন না হওয়াও ব্যান্ড ভাঙার একটি কারণ।

দেশের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ও তারুণ্যনির্ভর ব্যান্ডের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কনসার্ট কিংবা শোয়ের সম্মানীর সুষম বণ্টন না হওয়া, ব্যবসায়িক স্বার্থ, ভোকালের নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা, প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডের কারও চাকরি কিংবা ব্যবসায় ব্যস্ত থাকা, ভোকাল দ্বারা অন্য সদস্যদের ডমিনেট করা এবং স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করায় ব্যান্ডে ভাঙন দেখা দেয়। তাঁদের মতে, ব্যান্ড সমন্বিত একটা ব্যাপার। কোনো ভোকাল বা মূল গায়ক বেশি জনপ্রিয়তা পেলে তিনি দলের অন্য সদস্যদের ওপর ছড়ি ঘোরান।

ফিডব্যাক ব্যান্ডে অনেকবার সদস্যদের পরিবর্তন হয়েছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকাটা ব্যান্ড ভাঙার অনেক বড় কারণ বলে মনে করছেন দলটির অন্যতম সদস্য ফোয়াদ নাসের বাবু। তিনি বলেন, ‘ফ্রন্টম্যান বা ভোকাল যা–ই বলি না কেন, এই মানুষকে নিয়ে ব্যান্ডে সংকট তৈরি হয় বেশি। আমাদের লাইনআপে অসংখ্যবার পরিবর্তন হয়েছে। তারপরও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।’
গত বছর ভাঙনের মুখে পড়েছিল গানের দল শিরোনামহীন। শেষ পর্যন্ত তানজীর তুহিন আভাস নামের আরেকটি ব্যান্ড গড়েন। আর বাকি সদস্যদের নিয়ে জিয়া শিরোনামহীনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
জিয়া বলেন, ‘আমাদের দেশে পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশন ভোকালকে নিয়ে মাতামাতি করে। এতে এক ধরনের অহংবোধ তৈরি হয় তাঁর মধ্যে। আচরণে তা প্রকাশ পায়। কিন্তু দলের ভোকাল কিংবা দলনেতা হিসেবে তো তাঁর বোঝা উচিত, প্রতিটি সদস্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বাকি সদস্যদের স্যাক্রিফাইস কতটুকু? এসব ভুলে গেলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, যা মোটেও প্রত্যাশিত নয়।’
দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলসেও কয়েকবার ভাঙন হয়। অন্যতম সদস্য শাফিন আহমেদ আলাদা করে ব্যান্ড গড়েন। সব ধরনের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে মাইলসে শাফিন আবার ফিরে আসেন।