চাঁদে পাওয়া মানুষের গল্প

>

নিল আর্মস্ট্রংয়ের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন রায়ান গসলিং
নিল আর্মস্ট্রংয়ের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন রায়ান গসলিং

২০ জুলাই চন্দ্রজয়ের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় চাঁদে পা রাখা প্রথম মানুষ নিল আর্মস্ট্রংয়ের জীবনী–সিনেমা ফার্স্টম্যান। আর্মস্ট্রংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বানানো এই সিনেমা রাজনৈতিক নয়, বরং পৃথিবীর মানুষের চন্দ্রজয়ের দলিল।

ছেলেবেলায় ‘আয় আয় চাঁদ মামা’ ছড়াটি কে শোনেনি? কিন্তু সেই ছড়ার ডাকে সাড়া দিয়ে ‘চাঁদ মামা’ কখনো আমাদের কপালে টিপ দিয়ে যায়নি। বরং মানুষ চাঁদের বুকে পায়ের ছাপ রেখে আসার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল; ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’ বেঁধে গিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরি গ্যাগারিন পৃথিবীর চারপাশ থেকে ঘুরে আসার পর মার্কিন কর্তাদের মাথাও ঘুরে যায়। তার কিছুদিন পর প্রথম নারী হিসেবে মহাকাশ চক্কর দিয়ে আসেন ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা। কেবল মানুষ নয়, লাইকা নামের এক কুকুরও পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সব দেখেশুনে সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির জেদের পারদ উঠে যায় মহাকাশে। ঘোষণা দিয়ে বসেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু পৃথিবীর চারপাশে মানুষ পাঠিয়ে বসে থাকবে না, চাঁদেও মানুষ পাঠাবে। কেনেডির ঘোষণা বাস্তবে রূপান্তর করে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রাখেন মার্কিন নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং। চাঁদকে কাছ থেকে দেখার আকুলতা, সুদূরপ্রসারী বৈজ্ঞানিক চিন্তা কিংবা রাজনৈতিক জেদাজেদির এই গল্পটাই চালু আছে পৃথিবীজুড়ে। কিন্তু চাঁদে প্রথম পা রাখা নিল আর্মস্ট্রংয়েরও তো একটা ব্যক্তিগত গল্প আছে। কেন তিনি চাঁদে গেলেন? চাঁদে যাওয়ার আগে ও পরে তাঁর জীবনে কী ঘটেছিল? সেই গল্প নিয়েই ফার্স্ট ম্যান। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় নিল আর্মস্ট্রংয়ের একমাত্র জীবনী ফার্স্ট ম্যান: দ্য লাইফ অব নিল এ. আর্মস্ট্রং। লিখেছিলেন মার্কিন অধ্যাপক জেমস আর হ্যানসেন। এই জীবনী অবলম্বনেই ২০১৮ সালে সিনেমাটি বানিয়েছেন অস্কারজয়ী তরুণ নির্মাতা ডেমিয়েন শ্যাজেল। নিল আর্মস্ট্রংয়ের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন রায়ান গসলিং, আর্মস্ট্রংয়ের স্ত্রী জ্যানেটের ভূমিকায় ছিলেন ক্লেয়ার ফয়। বেস্ট ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস বিভাগে অস্কার জেতে ফার্স্ট ম্যান।

ফার্স্ট ম্যান ছবির পোস্টার
ফার্স্ট ম্যান ছবির পোস্টার

সিনেমার শুরু ১৯৬১ সাল থেকে। নিল আর্মস্ট্রং তখন নাসার টেস্ট পাইলট। স্পেস প্লেন নিয়ে উড়ে গিয়েছেন শূন্যে। কিন্তু গোত্তা খেয়ে নেমে আসতে বাধ্য হন মরুভূমিতে। সহকর্মীরা আর্মস্ট্রংয়কে আরও মনোযোগী হতে বলেন। কিন্তু মনোযোগ দেবেন কী করে? আড়াই বছরের কন্যা ক্যারেনের মাথায় টিউমার ধরা পড়েছে। অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটাকে ধরে রাখতে পারেন না আর্মস্ট্রং। সেই শোক ভুলতেই আবেদন করেন নাসার দ্বিতীয় মহাকাশ অভিযান ‘প্রোজেক্ট জেমিনি’তে। মনোনীতও হয়ে যান দ্রুত। স্ত্রী জ্যানেট ও ছেলে রিককে নিয়ে হিউস্টনে চলে যান আর্মস্ট্রং। নাসার অ্যাস্ট্রোনট গ্রুপ টু–এর সতীর্থদের সঙ্গে নেমে পড়েন প্রস্তুতিপর্বে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ততদিনে মহাকাশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে নাসা। ১৯৬৫ ও ১৯৬৭ সালে প্রস্তুতিপর্বে চার সতীর্থকে হারান আর্মস্ট্রং। নিজেও একবার বেঁচে যান অল্পের জন্য।

এত এত কষ্ট ভুলতে আর্মস্ট্রং চোখ রাখেন চাঁদে। অ্যাপোলো ১১–এর কমান্ডার হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর আর্মস্ট্রংকে চাঁদ আরও পেয়ে বসে। স্ত্রী ও দুই ছেলের সঙ্গে বাড়তে থাকে দূরত্ব। আর্মস্ট্রং কি মায়া কাটানোর জন্যই অমন আচরণ করেছিলেন? হয়তোবা। সিনেমার একটা জায়গায় আর্মস্ট্রংয়ের স্ত্রী ছেলেকে বলেন, ‘তোমার বাবা চাঁদে যাচ্ছেন।’ ছেলের প্রশ্ন, ‘আমি কি এখন একটু বাইরে যেতে পারি?’

১৬ জুলাই যখন আসন্ন, আর্মস্ট্রং যখন চাঁদে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছেন, তখন তাঁর স্ত্রী রাগে–দুঃখে ভেঙে পড়েন। কারণ, আর্মস্ট্রং ছেলেদের কাছে বিদায় নিতেও গড়িমসি করছেন। শেষমেশ আর্মস্ট্রং অবশ্য ছেলেদের কাছ থেকে বিদায় নেন। কিন্তু বিদায়দৃশ্য দেখে মনে হয়, আর্মস্ট্রং যেন গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে যাচ্ছেন!

পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃসাহসী অভিযান সফলভাবেই শেষ করেন আর্মস্ট্রং। চাঁদের মাটিতে পা রাখার কিছুক্ষণ পর স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখেন অজানা কারণে। ভীষণ নিভৃত এক জীবন কাটিয়েছেন এই নভোচারী। তাঁর সাক্ষাৎকার পাওয়া চাঁদে যাওয়ার মতোই কঠিন ছিল। স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখার ওই সময়টুকু কী করেছিলেন আর্মস্ট্রং? এই সিনেমায় সে উত্তর পাওয়া যায়। চাঁদের মাটি আর্মস্ট্রংয়ের প্রিয় কন্যা ক্যারেনের বিশেষ এক স্মৃতি হয়তো আগলে রেখেছে এখনো!

ফার্স্ট ম্যানের টুকিটাকি

● নিভৃতচারী ছিলেন বলে নীল আর্মস্ট্রংয়ের ভেতরের কথা খুব বেশি জানার উপায় নেই। সেদিক থেকে এই সিনেমা ভালো খোরাক। ২০১২ সালে মারা যান আর্মস্ট্রং। মৃত্যুর আগে সিনেমাটি নিয়ে কথা বলতে গেলে তাঁর জীবনীর লেখক জেমস আর হ্যানসেনের ওপর ভরসা রেখেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘ও থাকলে আমি নিশ্চিন্ত।’

● আর্মস্ট্রংয়ের দুই ছেলে রিক ও মার্ক বলেছেন, তাঁদের বাবাকে নিয়ে বানানো সব সিনেমার মধ্যে ফার্স্ট ম্যান সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য।

● সিনেমাটির প্রস্তুতিপর্বে আর্মস্ট্রংকে নিয়ে গবেষণা করেছিলেন রায়ান গসলিং। সে সময় তিনি আবিষ্কার করেন, থেরামিন নামের একটি বাদ্যযন্ত্রের বিশেষ ভক্ত ছিলেন আর্মস্ট্রং। সিনেমার পরিচালক ডেমিয়েন শ্যাজেল ও সংগীত পরিচালক জাস্টিন হারউইটজকে বিষয়টি জানান গসলিং। পরে সিনেমার সংগীতে থেরামিন ব্যবহার করেছিলেন হারউইটজ।

● সিনেমাটি বিশ্বাসযোগ্য করতে পরিচালক শ্যাজেল কোনো ক্ষেত্রেই বাড়তি কিছু করেননি। অভিনয়, মেক–আপ, শব্দ, সেট এবং মহাকাশের দৃশ্য—সব কিছুই স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছেন সুচিন্তিতভাবে। এমনকি আর্মস্ট্রংয়ের বাড়ির মূল নকশা ধরেই সেটের বাড়িটি বানানো হয়েছিল।

● সিনেমাটিতে চাঁদের বুকে মার্কিন পতাকা ওড়ানোর কোনো দৃশ্য রাখেননি শ্যাজেল। এ নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এর সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘দেখব না ওই সিনেমা।’ কিন্তু শ্যাজেল ও গসলিং বেশ শক্ত যুক্তি দিয়ে এই বিতর্ক সামলেছেন। তাঁদের দাবি, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিনেমা বানানো হয়নি। নীল আর্মস্ট্রং নিজেকে ‘আমেরিকান হিরো’ ভাবতেন না। চাঁদে যাওয়ার ঘটনাটি গোটা মানবজাতির অর্জন হিসেবেই দেখানো হয়েছে ফার্স্ট ম্যান–এ।