যে জীবন পুতুলের

বড় হয়ে পুতুল হতে চাই—কে কবে এমনটি শুনেছেন! অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কাজী নওশাবা আহমেদও সেটা চাননি। কিন্তু একদিন ঠিকই তিনি পুতুল হয়ে গেলেন। পুতুলের নাম ‘ইকরি’। সিসিমপুর নামে শিশুদের (বড়দেরও) খুব প্রিয় টিভি অনুষ্ঠানে ইকরি চরিত্রে কণ্ঠাভিনয় করতেন নওশাবা। সেই থেকে শুরু। এখনো পুতুলজীবন কাটাচ্ছেন তিনি। একটি দল গড়েছেন টুগেদার উই ক্যান নামে। দলের সদস্যদের গলার স্বর, আচার-আচরণও নাকি পুতুলের মতো হয়ে গেছে।

৬ জুলাই একটি পাপেট শো, মানে পুতুলনাট্য মঞ্চস্থ করল নওশাবাদের দল। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করা একদল পাপেটশিল্পী ছিলেন এর নেপথ্যে। দিনের পর দিন পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনকেন্দ্র সিআরপিতে গিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে টুগেদার উই ক্যান। দলে আছেন অমিত সিনহা, চয়ন কুমার, শারিব হাসান, এজাজ ফারহা, তনিমা, মুন্না, মিলন, বাঁধন, শান্ত। পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক তরুণীর জীবন নিয়ে পাপেট শো ‘মুক্তি আলোয় আলোয়’। সেটা শেষ করে একটু পেছন ফিরে চাইলেন নওশাবা।

পড়ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। রীতিমতো জোর করেই বন্ধুরা পাঠালেন ‘সিসিমপুর’-এ কাজ করতে। পাপেট বলতে মুস্তাফা মনোয়ারের পাপেটগুলোকেই চিনতেন তিনি। ‘সিসিমপুর’-এ কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় মার্টিন পি রবিনসনের সঙ্গে। মার্কিন এ পাপেটিয়ারকে দেখে বিস্মিত নওশাবা। একটি মানুষ কীভাবে একই সময়ে ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন, সেটাও কেবল কণ্ঠ দিয়ে! তাঁর কাছেই হাতেখড়ি নওশাবার। আর সেই থেকে শুরু।

নওশাবা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমিন
নওশাবা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমিন

পাপেটিয়ার হতে চাইলে অহংকার থাকা চলবে না। কারণ, পুতুলের অহংকার নেই। মানুষের ভেতরে কিছুদিন পরপর অহংকার জমে ওঠে। সেসব ধুয়ে-মুছে শূন্য করে পাপেটের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। অহং নিয়ে পুতুলের ভেতর ঢুকলে, সেই পুতুল কি আর শিশুদের আনন্দ দিতে পারে? এসব কারণেই ইকরিরা এত জনপ্রিয়। ইকরিদের দেখে বড় হয়েছে এ রকম অনেকের সঙ্গে এখনো ফোনে কথা বলেন নওশাবা। মানে ইকরিকে ফোন করেন তাঁরা। ইকরির কণ্ঠে নওশাবা তাঁদের অনুপ্রেরণা দেন।

একটি দুর্ঘটনার পর হুইলচেয়ারে চলাফেরা শুরু করেছিলেন নওশাবা। চিকিৎসকেরা নিষিদ্ধ করেছিলেন যাবতীয় পাপেট-অভিনয়। নিয়মিত নানা রকম থেরাপিও চলত। মনোবল ফিরে পেতে তিনি দেখা করেন সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি টেইলরের সঙ্গে। তিনি নওশাবাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের জন্য কিছু একটা করো।’ তাঁর কথামতো নওশাবা উঠে দাঁড়িয়ে আবারও পাপেট হাতে তুলে নেন। দূরে সরিয়ে রাখেন হুইলচেয়ার। সেই পাপেট আরও শক্তি এনে দেয় তাঁর শরীরে, মনে।

উধাও নামের একটা ছবিতে যৌনকর্মীর চরিত্রে কাজ করেছিলেন নওশাবা। পরে আরও বেশ কিছু ছবিতে। ঢাকা অ্যাটাক-এ পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য দারুণ প্রশংসিত হন তিনি। তবে অভিনয়ে এসে পাপেটের জীবনটা হারাতে চাননি নওশাবা। তাই আবার পুতুলদের কাছে ফিরেছেন। কারণ, ইকরিকে তিনি নিজেই ভালোবেসে ফেলেছিলেন। সব সময় কামনা করতেন, যেন ইকরির মতো একটা মেয়ে হয় তাঁর। নওশাবার মেয়ে প্রকৃতি খুব ভাবুক, খুব দয়ালু, ভীষণ মায়াবী। একেবারেই ইকরির মতো।