দেশে ডাবিং শিল্পের পরিসর বাড়ছে

সুলতান সুলেমান ধারাবাহিকের দৃশ্য। ডাবিংকৃত এই বিদেশি ধারাবাহিক দর্শকেরা বেশ পছন্দ করেছে।
সুলতান সুলেমান ধারাবাহিকের দৃশ্য। ডাবিংকৃত এই বিদেশি ধারাবাহিক দর্শকেরা বেশ পছন্দ করেছে।

ডাবিং শিল্পের পরিসর বাড়ছে ক্রমশ। পেশা হিসেবেও এটি দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা ডাবিং শিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পীদের। টেলিভিশন চ্যানেলে শুধু ডাবিং শিল্পী হিসেবেই কাজ করছেন অনেকে। পাশাপাশি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছেন আরও নানা পেশার লোক। মিডিয়া–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ক্ষেত্রটি ধীরে ধীরে পেশা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে।

কিছু টেলিভিশন চ্যানেলে নিজস্ব ডাবিং বিভাগ আছে। সেখানে ডাবিং শিল্পীর পাশাপাশি বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছেন প্রযোজক, শব্দ সম্পাদক, পাণ্ডুলিপি তত্ত্বাবধায়ক, সম্পাদক, অনূদিত সংলাপ রচয়িতাসহ (এডিটিং) নানা সৃজনশীল মানুষ। দীপ্ত টিভির ডাবিং বিভাগের প্রধান ব্রাত্য আমিন জানান, তাঁদের বিভাগে স্থায়ীভাবে ডাবিং শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন ২৫ জন, অনুবাদে ২১ জন, শব্দ পরিকল্পনায় ১৭ জন এবং ভিডিও এডিটর হিসেবে কাজ করছেন ৩ জন। এই বিভাগে স্থায়ী ও অস্থায়ী ডাবিং শিল্পী–কলাকুশলী মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন কাজ করেন।

সাম্প্রতিককালে বিদেশি সিরিয়াল ঘিরে বেশ আলোচনায় আসে ডাবিং শিল্পটি। দীপ্ত টিভির সুলতান সুলেমান নামের তুরস্কের ধারাবাহিকটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। বিভাগীয় প্রধান ব্রাত্য আমিন বলেন, ‘ডাবিং শিল্পটি একটি পেশা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে যাঁরা থিয়েটার করেন, এটি তাঁদের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে এসেছে। বাংলাদেশে অন্যান্য চাকরি করে থিয়েটার করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে ডাবিং শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই থিয়েটার ও চাকরি দুটোই করতে পারছেন। স্থায়ী ডাবিং শিল্পী হিসেবে অনেকেই কাজ করছেন।’

দীপ্ত টিভির গবেষণা বিভাগের প্রধান সুবর্ণা পারভীন বলেন, ‘একটা সময় বিটিভিকেন্দ্রিক ডাবিং শিল্প বেঁচে ছিল। এটা এখন পেশা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। এটি ডাবিং শিল্পের পুনর্জাগরণ বলতে পারেন। এই শিল্পের সঙ্গে শুধু ডাবিং শিল্পীরাই জড়িত নন; অনুবাদক, শব্দ পরিকল্পক, এডিটর—অনেকেই জড়িত। সুতরাং এটাকে নতুন একটি কর্মসংস্থানের উপায় বলা যায়। তা ছাড়া বাংলাদেশের কোনো চ্যানেলের সঙ্গে শিল্পীরা পারমানেন্ট নন, কিন্তু ডাবিং শিল্পের সঙ্গে অনেকেই পারমানেন্ট। এটা আরও বাড়বে। আর অনেক দেশেই ডাবিং হচ্ছে। এটা নতুন নয়। এই ধারাবাহিকগুলোর মেকিং অনেক ভালো, দর্শকের কাছে জনপ্রিয়, তাই এই কনটেন্টগুলো ডাবিং করা হচ্ছে। পাশের দেশ ভারতেও বিদেশি ভালো কনটেন্ট ডাবিং করে প্রচার করা হচ্ছে।’

ডাবিং শিল্পীদের অনেকেরই থিয়েটার থেকে আসা। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় থিয়েটার থেকে আয় করার সুযোগ নেই। কিন্তু একজন থিয়েটারকর্মী কণ্ঠাভিনয় করে টাকা আয় করে সহজেই থিয়েটার চর্চাও করতে পারছেন। এমনকি টেলিভিশনগুলোও থিয়েটার কর্মী, নাট্যকলা বিভাগ ও বাংলা বিভাগে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। দুরন্ত টেলিভিশন সূত্র জানিয়েছে, তারা ডাবিং শিল্পকে কণ্ঠাভিনয় বলতে চান। এর জন্য কণ্ঠাভিনয়ের কৌশল নিয়েও কর্মশালা করানো হয়। নিয়মিত কণ্ঠাভিনয় এবং দীপ্ত টিভির প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন থিয়েটার কর্মী শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তরুণ থিয়েটার কর্মীদের জন্য এটা খুবই ভালো একটি প্ল্যাটফর্ম। পেশা হিসেবেও অনেকেই নিচ্ছে। এর পাশাপাশি বাইরের বিভিন্ন ডাবিং হাউসও শিল্পটি নিয়ে কাজ করছে।’

একসময় বেশ কিছু বিদেশি সিরিয়াল জনপ্রিয় ছিল ম্যাগাইভার, আলিফ লায়লা, দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব সিন্দাবাদ ইত্যাদি। এ ছাড়া বিদেশি সিনেমা দেখানো হতো। সেসব ঘিরে ডাবিং শিল্প চর্চা ছিল। এখন বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করেও ডাবিং চর্চা চলেছে। বর্তমানে বিজ্ঞাপন, বিদেশি ধারাবাহিক, সিনেমা, কার্টুন ও নানা ধরনের কনটেন্ট নির্মাণে ডাবিং শিল্পীরা কাজ করছেন। এসবকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু স্টুডিও গড়ে উঠেছে। শো এস আর কে প্রতিষ্ঠানে ভয়েস অ্যাক্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন সামিউল জীবন। তিনি বলেন, ‘আমি থিয়েটারের মানুষ। থিয়েটার থেকে আয়ের সুযোগ নেই। তাই অন্য পেশা বেছে নিতে হয়। যেহেতু কণ্ঠাভিনয় মূলত অভিনয়ই, তাই এই পেশায় আছি। তবে একটা কথা আছে, নব্বইয়ের দশকে ভয়েস ডাবিং বলা হতো। এখন এটা পরিবর্তন হয়ে ভয়েজ অ্যাক্টিং বলা হচ্ছে। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর কোনো ছবিতে কণ্ঠ দিতে হলে আমাদের ওর অভিনয়টাকেই কণ্ঠে ধারণ করতে হয়। এটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। মনে রাখতে হবে, শাহরুখ খানও কণ্ঠাভিনয় করেন। এমনকি তাঁর ছেলের অভিনয়ে অভিষেক হয়েছে কণ্ঠাভিনয় দিয়ে।’

দীপ্ত টিভির ডাবিং বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন জয়শ্রী মজুমদার। একসময় বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ দিতেন তিনি। তখন থেকেই মনে আশা এটিকে পেশা হিসেবে পাওয়ার। জয়শ্রী বলেন, ‘ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেওয়ার পর আমি বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ দিতাম। তারপরে এখানে যুক্ত হই। আমাদের একটা স্বপ্ন থাকে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করার। কিন্তু এটা তো সবার ক্ষেত্রে হয় না। সে ক্ষেত্রে ডাবিং সেই অভিনয়ের জায়গাটা করে দিয়েছে।’

দুরন্ত টিভিতে দুই শ জনের বেশি অস্থায়ী কণ্ঠাভিনয়শিল্পী আছেন। টিভির অনুষ্ঠান প্রধান মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন, ‘এটার মাধ্যমে বাংলাদেশে নাট্যকলা ও বাংলায় পড়ুয়া ও থিয়েটার চর্চাকারীদের কর্মসংস্থান হলো। শিক্ষার্থী অবস্থায় থেকেই তাঁদের একটা অর্থ আয়ের সুযোগ হচ্ছে। এখন যেহেতু অনেক টেলিভিশন চ্যানেল। সারা বিশ্বের কনটেন্টই সবার কনটেন্ট। তা ছাড়া কনটেন্টের অপ্রতুলতা আছে। বিশ্বের দিকে আমাদের হাত বাড়াতেই হচ্ছে। সব টেলিভিশনেই এখন বিদেশি কার্টুন, নাটকসহ অনেক কনটেন্টই হচ্ছে। তাই এই কাজের গুরুত্ব আছে। এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া যেতে পারে।’