বাংলাদেশের কে-পপ ভক্তমহল

কে–ড্যান্সের চর্চা করে নিজেদের তুলে ধরছেন বাংলাদেশের মেয়েদের দল ‘রেবেলস গ্রুভ’
কে–ড্যান্সের চর্চা করে নিজেদের তুলে ধরছেন বাংলাদেশের মেয়েদের দল ‘রেবেলস গ্রুভ’
>ভালোবাসা আর সমালোচনা, উত্তর-দক্ষিণ মেরুর মতো। কে–পপ বা কোরিয়ান পপের বাংলাদেশে যেমন রয়েছে এক বিরাট ভক্তমহল, তেমন আবার নিন্দুকও রয়েছেন। তবে আমরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কথা বলেছি কে–পপ যাঁরা শোনেন, দেখেন আর চর্চা করেন, তাঁদের সঙ্গে। কীভাবে ভিনদেশি এই ঘরানার সঙ্গে যুক্ত হলেন বাংলাদেশি দর্শক–শ্রোতা, জানতে চেয়েছিলাম তাঁদের কাছে। সে সময়ই জানা গেল, শুধু কোরীয় গান শুনে বা দেখেই থেমে নেই তাঁরা, এমনকি এর চর্চা করে সুদূর কোরিয়া পর্যন্ত চলে গেছেন বাংলাদেশি তরুণ শিল্পীরা। সেসব নিয়েই লিখেছেন মুসাব্বির হুসাইন।

২০১৩ সালের কথা। টিভির রিমোট হাতে চ্যানেল ঘোরাচ্ছিলেন শেফা। হঠাৎ একটি চ্যানেলে চোখ আটকে গেল। এক বিশাল দল নাচছে। দেখে মনে হচ্ছে জাপানের অ্যানিমে থেকে বেরিয়ে আসা কিছু মানুষ। কে পপের এ রকম ভিজ্যুয়াল ড্যান্স দেখে খানিকটা আগ্রহ জন্মাল শেফার মনে। শুরু হলো এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। গান, ফ্যাশন, ভিডিওগ্রাফি—সবকিছুই টানত শেফাকে। তবে নাচের দিকে তাঁর ঝোঁকটা ছিল বেশি। তার ওপর হঠাৎ দেখা ওই দলের নাচ পুরো বিগড়ে দিল শেফাকে। সেই থেকে কোরীয় পপ দলের কোরিওগ্রাফির অনুসরণ ও চর্চা শুরু করেন তিনি। শেফার জীবনে সেই থেকে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়।

বাংলাদেশের মেয়ে শেফা কে–ড্যান্স দিয়ে জিতেছেন কোরীয় শিরোপা
বাংলাদেশের মেয়ে শেফা কে–ড্যান্স দিয়ে জিতেছেন কোরীয় শিরোপা

শেফা তাবাসসুম এখন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজমের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। কে–পপের প্রতি ভালোবাসা থেকে গত বছর অংশ নেন ঢাকায় অনুষ্ঠেয় কোরিয়ান ওয়ার্ল্ড ফেস্টিভ্যালে। সেখানে নাচের বিভাগে রানারআপ হওয়ার এক মাস পরে যোগাযোগ করা হয় তাঁর সঙ্গে। কে–পপ নাচের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বাংলাদেশের এই মেয়ে যান কোরিয়াতে, নাচেন ফাইনাল রাউন্ডে। এই যাত্রায় শেফার পুরোটা খরচ বহন করে কেবিএস ওয়ার্ল্ড নামে জনপ্রিয় কোরীয় টেলিভিশন নেটওয়ার্ক।

কোরিয়াতে শেফা ছিলেন প্রায় দুই সপ্তাহ। বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও নানান দেশের শিল্পী ও দল। শেষমেশ নাচ দিয়ে শেফা সেই সব শিল্পী ও দলকে হারিয়ে জিতে নেন ‘বেস্ট সলো পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড’। এভাবেই বাংলাদেশি কে–পপের ভক্তরা নিজেদের ছাপ ফেলতে শুরু করেছেন বিভিন্ন জায়গায়।

বাংলাদেশের কে–পপ কমিউনিটি এখন বিশাল এক পরিবার। ৫ সদস্য নিয়ে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিডি কে ফ্যামিলি। ৯ বছর পর এই দলে এখন ১৫ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাসনুভা জাহান ও টিনা জাহান মূলত বোন। আর কমিউনিটির সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম। বিডি কে ফ্যামিলির সদস্যদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক শক্ত রাখছেন। তাঁরা নিয়মিত আয়োজন করছেন বড় বড় অনুষ্ঠান। রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক কার্যক্রমের সুযোগ। বিডি কে ফ্যামিলি প্রতিবছর আয়োজন করছে ‘বিডি কোরিয়ান ফেস্টিভ্যাল’। দুই দিনের এই অনুষ্ঠানে থাকে নাচ ও গানের প্রতিযোগিতা, তায়কোয়ান্দো (কোরিয়ান মার্শাল আর্ট), কোরীয় রান্নাসহ মজার সব আয়োজন। এ ছাড়া বছরের শুরু দিকে থাকে ‘ঢাকা কে মিট’। এসব আয়োজনের বেশির ভাগের সঙ্গে খোদ ঢাকার কোরিয়ার দূতাবাসও সম্পৃক্ত থাকে।

এ ছাড়া কে–পপের ভক্তদের আরেকটি বড় সম্মিলন হয় কে–পপওয়ার্ল্ডফেস্টিভ্যালে। ঢাকার দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাস আয়োজিত অনুষ্ঠানটির ঢাকা পর্বের উৎসবটি হয় ২৭ জুলাই। এবার এই উৎসবের মূল প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় নাচের দল ‘রেবেলস গ্রুভ’। সব ঠিকঠাক থাকলে চূড়ান্ত বাছাইপর্ব উতরে গেলে শেফার মতো বাংলাদেশি মেয়েদের এই নাচের দল কোরিয়ায় গিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নাচের সুযোগ পাবে। এর আগে এই দলই ২০১৮ সালের বিডি কে ফ্যামিলি আয়োজিত ‘বিডি কোরিয়ান ফেস্টিভ্যাল’–এ বিজয়ী হয়েছিল।

টিনা জাহানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম কে পপ নিয়ে কাজ করতে কেমন লাগে? উত্তরে খানিকটা হেসে টিনা বললেন, ‘যখন দেখি ভক্তরা ওদের ভালোবাসার জায়গাটিকে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন খুব ভালো লাগে। ছোটবেলায় আমি এভাবে প্রিয় গান, শিল্পী বা দলের প্রতি এভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারিনি। সেই সুযোগ ছিল না। এখনকার ভক্তদের জন্য কিছু করতে পেরে আমার ভালো লাগে।’

মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গ্র্যাজুয়েট সানজিদা। বিটিএসের গান ভালো লাগাকে তিনি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘গান মানেই যে শুধু প্রেম–ভালোবাসা–বিরহ এসব হতে হবে, তা নয়। এটা আমি শিখেছি বিটিএসের থেকে। আমাদের প্রজন্ম যেসব সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়, ওদের বেশির ভাগ গানে সেসব কথাই থাকে। মনে হয় ওরা আমাদের কথাই বলছে।’

বিডি কে–ফ্যামিলির একটি অনুষ্ঠানে কোরীয় তারকার কাটআউটের সঙ্গে তরুণ ভক্তরা
বিডি কে–ফ্যামিলির একটি অনুষ্ঠানে কোরীয় তারকার কাটআউটের সঙ্গে তরুণ ভক্তরা

ডাকনাম অংকন, জেক ভার্নার নামেও পরিচিত তিনি। কে–পপওয়ার্ল্ডফেস্টিভ্যালে তাঁর পারফরম্যান্সের সময় গলা ফাটিয়েছেন প্রায় সব দর্শক। অংকনের সঙ্গে কথা হলো ওই উৎসবেই। জানা গেল, বিটিএসের সদস্য পার্ক জিনিম তাঁর অনুপ্রেরণা। জিমিন অনেক পরিশ্রমী। জীবনে অনেক অনিশ্চয়তা থাকলেও সেগুলো অতিক্রম করেছেন পরিশ্রমের মাধ্যমে। ইউটিউব দেখে দেখে নিজেই শিখেছেন কে–ড্যান্স।

কিশোর-তরুণসহ বিভিন্ন বয়সীরা এখন কোরিয়ান পপের ভক্ত। অনেকেই হয়তো এদের অপছন্দ করেন বা কড়াভাবে সমালোচনাও করেন। কিন্তু তাতে তাঁরা দমে যাওয়ার পাত্র নন। এক ভক্ত বলেছিলেন, কে–পপ তাঁর মধ্যে ইতিবাচক ভাবনা সৃষ্টি করতে শিখিয়েছে; জাতি–বর্ণ, গায়ের রং, পোশাক বা বেশভূষা দিয়ে কাউকে বিচার না করতে শিখিয়েছে। নিজেকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করিয়েছে; শিখিয়েছে অন্যকে সম্মান করতে। এভাবেই একটি দেশের বিনোদন মাধ্যমে আরেকটি দেশের প্রজন্মকে দেখিয়ে যাচ্ছে আলোর পথ।