এলআরবি নিয়ে যাচ্ছেতাই!

আইয়ুব বাচ্চু এবং নতুন এলআরবি
আইয়ুব বাচ্চু এবং নতুন এলআরবি

আইয়ুব বাচ্চুর বিদায়ের এক বছরও হয়নি। গত বছরের ১৮ অক্টোবর সকালে চলে গেলেন ‘গিটারের জাদুকর’! এই শোক কাটেনি। বরং বেড়েছে তাঁর দল এলআরবি এবং তাঁর গান নিয়ে নানান সংকট। বেড়েছে ভক্তের হতাশা। বারবার এলআরবি ভাঙছে, গড়ছে। পুরোনো সদস্যরা যে যাঁর মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

জীবনকালে এই দলটি ঘিরেই আইয়ুব বাচ্চুর যত সব কর্মযজ্ঞ। নিজে যেমন বিভিন্ন সময়ে নানান ব্যান্ডের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন, তেমনি এলআরবি গঠনের পর সেটাকেই একটি পরিবারের মতো গড়ে তুলেছিলেন। বলতেন, ‘এটা আমার আরেকটা পরিবার।’ নিজে নেতৃত্ব দিয়ে এক হাতে দলটি চালাতেন। তাঁর সেই দল নিয়ে এখন যাচ্ছেতাই হচ্ছে!

কেক কেটে এলআরবির সদস্যদের ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন। এখন সবই স্মৃতি।
কেক কেটে এলআরবির সদস্যদের ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন। এখন সবই স্মৃতি।

সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার নতুন লাইনআপের ঘোষণা দিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য গিটারিস্ট সাইদুল হাসান স্বপন। ড্রামার রোমেলকে বাদ দিয়ে নিজেই নতুন করে এলআরবির লাইনআপ ঘোষণা করেছেন স্বপন। নতুন ভোকাল হিসেবে নিয়েছেন ব্যান্ড তারকা মিজানকে, যিনি এর আগে ওয়ারফেজের মূল ভোকাল ছিলেন। এলআরবির নতুন লাইনআপে আছেন স্বপন (ব্যান্ড লিডার ও বেজ), পুষ্প ফেরদৌস (গিটার) ও অমিত (ড্রামস)। এই লাইনআপ নিয়ে এলআরবির গানের অনুশীলনের ভিডিও দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যেখানে মিজানকে ‘চাঁদমামা’, ‘ঘুমন্ত শহরে’ ইত্যাদি গান গাইতে শোনা গেছে, দেখা গেছে অনুশীলনের ভিডিও চিত্র।

সাইদুল হাসান স্বপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলআরবির সদস্য মাসুদ ও শামীম ভাইয়ের অপেক্ষায় আছি। তাঁদের জায়গায় কাউকে নিইনি। তারা এলে আগের মতোই আমরা শুরু করব।’|

তবে দলের সাবেক সদস্য শামীম বলেন, ‘আমাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে আগেই বাদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আমার জন্য অসম্মানের ছিল। কিন্তু এলআরবির এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কোনো রকমের প্রতিবাদ কিংবা অভিযোগ করিনি। এখন এসে আবার নতুন করে দল গঠনের খবরটি আমাকে অবাক করেছে। হাস্যকরও মনে হয়েছে।’ দলের অপর সদস্য মাসুদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। শুধু এটুকুই বলেছেন, ‘অপেক্ষা করুন আরও কিছুদিন সময় যেতে দিন।’

প্রতিষ্ঠাতা সদস্য গিটারিস্ট সাইদুল হাসান স্বপন ঘোষিত নতুন এলআরবি
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য গিটারিস্ট সাইদুল হাসান স্বপন ঘোষিত নতুন এলআরবি

নতুনভাবে দলের ঘোষণা প্রসঙ্গে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে নানান স্মৃতিচারণা করে সাইদুল হাসান স্বপন বলেন, ‘আমার গিটার শেখা শুরু বসের (আইয়ুব বাচ্চু) হাতেই। ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বসের পাশেই ছিলাম।’ ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চু, স্বপন, জয়, টুটুল মিলে এলআরবি ব্যান্ডের যাত্রা শুরু। সেই এলআরবিতে সর্বশেষ লাইনআপ ছিল আইয়ুব বাচ্চু, স্বপন, মাসুদ, রোমেল এবং ম্যানেজার হিসেবে শামীম। বাচ্চু ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর ব্যান্ড চলমান রাখার জন্য নানা সিদ্ধান্তে মতভেদ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকা, সবাই ব্যান্ড লিডার হতে চাওয়া—এভাবেই দ্বন্দ্বের শুরু।

রোমেলকে বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে স্বপন দাবি করেন, ‘এলআরবি ভাঙার অন্যতম কারিগর রোমেল। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর ব্যান্ড চালু রাখার স্বার্থে প্রতিটি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে রোমেল। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় টাকা নিয়ে যে কাউকে এলআরবিতে গান গাওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা, বাচ্চু ভাই এবং এলআরবির সম্মান রক্ষার্থে এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় আমার সঙ্গে রোমেল খারাপ আচরণ করে এবং বলে, সে আমার কোনো সিদ্ধান্ত মানবে না। এলআরবি করতে হলে আমাকে তার সিদ্ধান্ত মানতে হবে, এও বলা হয়।’ প্রথম আলোর কাছে স্বপন অভিযোগ করেন, আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবির গানের সরাসরি ধারণকৃত ভিডিও কনটেন্ট কোনো রকম অনুমতি (এলআরবি ও বাচ্চু ভাইয়ের পরিবার) ছাড়া বিদেশে গোপনে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিপুল পরিমাণ ডলার আত্মসাৎ করেছে।

নব্বই দশকের এলআরবি। বাঁ থেকে আইয়ুব বাচ্চু, এসআই টুটুল, মিলটন আকবর এবং স্বপন।
নব্বই দশকের এলআরবি। বাঁ থেকে আইয়ুব বাচ্চু, এসআই টুটুল, মিলটন আকবর এবং স্বপন।

গেল বছরের অক্টোবরে আইয়ুব বাচ্চুর মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই এলআরবির সদস্যদের মধ্যে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ শুরু হয়। প্রথমে বালামকে ভোকাল করে নতুন লাইনআপ ঘোষণা দেয় তারা। কিন্তু এর কিছুদিন যেতে না যেতেই দ্বন্দ্ব শুরু হয় সদস্যদের মধ্যে। আলাদা হয়ে যান সদস্যরা। সাইদুল হাসান স্বপন আর গোলামুর রহমান রোমেল একদিকে, আর অন্যদিকে চলে যান মাসুদ ও ম্যানেজার শামীম। তবে শেষ পর্যন্ত স্বপন আর রোমেলেরও একসঙ্গে থাকা হলো না।

এলআরবির আরেক লাইনআপ। বাঁ থেকে স্বপন, আইয়ুব বাচ্চু, এসআই টুটুল এবং রিয়াদ।
এলআরবির আরেক লাইনআপ। বাঁ থেকে স্বপন, আইয়ুব বাচ্চু, এসআই টুটুল এবং রিয়াদ।

এদিকে আইয়ুব বাচ্চুর গান নতুন করে পরিবেশনের আরেকটি খবর আলোচনায় এসেছে সম্প্রতি। আইয়ুব বাচ্চুর ৩৫টি গান নিয়ে নতুনভাবে কম্পোজিশন করছেন তরুণ গিটারিস্ট, কম্পোজার রাজীব হোসেন। জানা গেছে, গানগুলো তিনি তাঁর মতো করে কম্পোজিশন করেছেন। গানগুলো নিজের ইউটিউব চ্যানেলে সংরক্ষণের কথাও বলছেন তিনি।

এলআরবির প্রথম দিকের অ্যালবামের প্রচ্ছদ
এলআরবির প্রথম দিকের অ্যালবামের প্রচ্ছদ

এলআরবির ভাঙা-গড়া, নতুন করে গান করার বিষয়টিতে হতাশ ভক্তরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে এই নিয়ে নানা রকমের মন্তব্য দেখা গেছে। এম আর খান রাজীব নামের একজন ভক্ত আক্ষেপ নিয়ে বলেন, আইয়ুব বাচ্চুর নিজ হাতে করা ৩৫টি গান নতুনভাবে কম্পোজিশন করে বাজারে ছাড়বে, ভাবা যায় আইয়ুব বাচ্চুকে তারা কত অসম্মান করার চেষ্টা করছে! এক বছরও তো হলো না বস মারা গেছে, আর এখনই তার বাজানো বদলে ফেলতে হবে! এলআরবির ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই বলছেন, এসব ঘটনায় ব্যান্ড মিউজিকের কিংবদন্তি সর্বজনপ্রিয় আইয়ুব বাচ্চুকেই অপমান করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এলআরবির নতুন করে গড়ার উদ্যোগ এবং আইয়ুব বাচ্চুর গান করা প্রসঙ্গে পরিবারের সদস্য স্ত্রী ও দুই সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। বর্তমানে তাঁরা তিনজনই দেশের বাইরে আছেন।

সোলস ছেড়ে ১৯৯০ সালের ৫ এপ্রিল নিজের ব্যান্ড দল প্রতিষ্ঠা করেন আইয়ুব বাচ্চু, যার নাম রাখলেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরবর্তী সময়ে এর নাম বদলে রাখা হয় ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’। সেই বছরই এলআরবি তাদের যাত্রা শুরু করে একটি ডাবল অ্যালবাম দিয়ে, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ডাবল অ্যালবাম।