তিনি বাঁচেন চরিত্রে

মোস্তফা মনোয়ার। ছবি: আবদুস সালাম
মোস্তফা মনোয়ার। ছবি: আবদুস সালাম

সিনেপ্লেক্সের হলভর্তি দর্শক। বড় পর্দায় চলছিল আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ পরিচালিত সিনেমা লাইভ ফ্রম ঢাকা। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে একজন তাঁর পাশের জনকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, এই সাজ্জাদ কি আসলেই খোঁড়া?’ তাই আসল সাজ্জাদ অর্থাৎ মোস্তফা মনোয়ার যখন প্রথম আলোর মুখোমুখি, প্রথমেই ছুড়ে দিলাম প্রশ্নটা। এত বাস্তব অভিনয়ের রহস্য কী? উত্তর এল, ‘আমি তো অভিনয় করি না। কেবল ওই চরিত্রটা হয়ে উঠি।’ 

যে চরিত্র চিনিয়েছে তাঁকে 

কথায় কথায় জানা গেল, লাইভ ফ্রম ঢাকার সাজ্জাদ চরিত্রের জন্য তিনি শুটিংয়ের এক মাস আগে থেকেই ক্রাচ ব্যবহার করতেন। ক্রাচে ভর করেই অফিসে যেতেন। সেখানে বলেছিলেন, তিনি নাকি পায়ে আঘাত পেয়েছেন। লাইভ ফ্রম ঢাকা ছবির পরিচালকের ভাবনার সঙ্গেও তাঁর ছিল অদ্ভুত মিল। কেমন? ধরুন, পরিচালক ভাবছেন সাজ্জাদ চরিত্রটি এলোমেলোভাবে রাস্তা পার হওয়ার সময় কিছুটা এগোবে। তারপর ওপাশ থেকে একবার তাকাবে। তারপর গটগট করে হেঁটে চলে যাবে। সাজ্জাদ ঠিক সেভাবেই রাস্তা পার হয়। আবার পরিচালক হয়তো ভাবলেন, এখানে বসে ৫ সেকেন্ড পর সাজ্জাদ পা তুললে ভালো হয়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এইখানে একটু থামলে ভালো হয়। কিছু না বলতেই মোস্তফা মনোয়ার সাজ্জাদের হয়ে সেগুলো করেছেন। অর্থাৎ সাজ্জাদ চরিত্রটি পরিচালক আর অভিনয়শিল্পী দুজনেই একইভাবে চরিত্রায়ণ করতে পেরেছিলেন।

যেভাবে শুরু

এক দিনে সাজ্জাদ হয়ে ওঠেননি মোস্তফা মনোয়ার। যখন কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে পড়তেন, তখন বিভিন্ন হাউসের মধ্যে সব সময় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা চলত। কিন্তু মনোয়ার কিছুতেই অংশ নিতেন না। কলেজ শেষ করে যখন ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন মনে হলো, ‘হায় হায়, আমার কলেজজীবন শেষ। আমি তো কিছুই করলাম না।’ সেই আক্ষেপ থেকে এলাকায় নাটক করার জন্য মহড়া করতে লাগলেন। জাহাঙ্গীরনগরের একটা ‘আপু’র নির্দেশনায়। তারপর সেই ‘আপু’কে দেখে তাঁর মনে হলো, অভিনয়টা তাঁকে করতেই হবে। যদিও সেই নাটক আর হয়নি শেষমেশ। তবে মনোয়ার যোগ দিলেন প্রাচ্যনাটে। ভর্তি হয়েছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে। অভিনয়ের জন্য এক বছর পর বিষয় পরিবর্তন করে বিবিএতে ভর্তি হলেন। সেই সময় বন্ধুত্ব হয় অনিমেষ আইচ, বদরুল আনাম সৌদদের সঙ্গে। 

এরপর অনেক রাত কাটল। এক রাতে বন্ধু অনিমেষ আইচ ডাকলেন মোস্তফা মনোয়ারকে। সেই রাতে বন্ধুর অনুরোধে রাত ১টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত একটা নাটক লিখে শেষ করলেন। নাটকের নাম হলুদ। জীবনের সেই প্রথম নাটকের জন্য পেলেন সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার। তাঁর লেখা ভূতোগ্রাফার নাটকটিও বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তার আগে অবশ্য লাবণ্যপ্রভাসহ বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। আগন্তুক নাটকে তাঁকে দেখা গেছে বিহারি সাফাইকর্মীর চরিত্রে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন তিনি রেদওয়ান রনির মিস্টার জনি নাটকের জন্য। সেখানকার দয়াল চরিত্রটি মানুষের মনে দাগ কেটেছে। তবে এই চরিত্রটাও সহজ ছিল না মোস্তফা মনোয়ারের জন্য। বিশেষ করে একেবারে শেষ দিকের একটা দৃশ্যে—যখন মিস্টার জনি নামের কুকুরটা মরে পড়ে থাকবে, আর দয়াল তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে। কিন্তু জনি কিছুক্ষণ পরপর ‘মৃত্যু থেকে জেগে উঠে’ চোখ মেলে তাকিয়েছে। আর শট হয়েছে এনজি (নট গুড)। এমনিতেই নাকি পরিচালক হিসেবে রনি ‘পারফেকশনিস্ট’। মনঃপূত না হলে একটা শট ২০-২২ বার করে নেন।

বড় পর্দায় মোস্তফা মনোয়ার 

মোস্তফা মনোয়ারকে প্রথমবারের মতো বড় পর্দায় দেখা গেছে নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত গেরিলা ছবিতে। আর সম্প্রতি কাজ করেছেন রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত মেড ইন বাংলাদেশ ছবির কাজ। এই ছবিতে তাঁকে দেখা যাবে মূল প্রোটাগনিস্টদের একজন ডালিয়ার স্বামীর চরিত্রে। যে স্বামী অর্থনৈতিকভাবে স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল, স্ত্রীকে ভালোবাসে। আবার স্ত্রীকে শাসনও করতে চায়। স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তাঁর ভেতর হীনম্মন্যতাও কাজ করে। এ রকমই সাদা আর কালোর মিশেলে একটা জটিল মনস্তাত্ত্বিক চরিত্র। যেই চরিত্র হয়ে উঠতে, চরিত্রের মতো করে ভাবতে তাঁর সময় লেগেছিল।

মোস্তফা মনোয়ারের প্রশংসিত কিছু চরিত্র
মোস্তফা মনোয়ারের প্রশংসিত কিছু চরিত্র

আরও দুটি ছবিতে কাজ করেছেন মোস্তফা মনোয়ার। ফজলে রাব্বির ইতি, তোমার ঢাকা এবং অ্যাপল ট্রি ইন মাই হেড। দুটো ছবির কোনোটিই এখনো মুক্তি পায়নি। সম্প্রতি নূরুল আলম আতিকের মানুষের বাগান ছবির শুটিং শেষ করেছেন। এখানে তাঁর চরিত্রটা এমন একজন মানুষের, যিনি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সব হারিয়ে একসময় মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে যান। তারপর সুস্থ হওয়ার পরও তিনি মানসিক ভারসাম্যহীনের অভিনয় করে যান। কারণ, তখন অনেক মানুষ তাঁর কাছে টাকা পায়! 

তাঁর চরিত্রগুলোর রং সাদা না, কালোও না। ধূসর। সাদা-কালোর মাঝের সেই ধূসর রঙের চরিত্রটিই পর্দায় নানা রং দেখিয়ে চেনা মানুষটি হয়ে ওঠে। সেই সব চেনা মানুষকে মাথায় নিয়ে ঘুরতে ঘুরতেই তিনি একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। বেছে কাজ করার স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখতেই চাকরিটা করছেন, যাতে অভিনয়টা কেবল মনের তাগিদেই মন দিয়ে করতে পারেন। ছোটবেলা থেকে খুব চেনা শহর ঢাকার বদলে যাওয়া নিয়ে গল্প লেখেন। সেই গল্পগুলো নিয়ে বাঁধা বইয়ের নাম দেন মেলোড্রামা। তাই বড় আর ছোট পর্দায় যতবার তাঁকে দেখা যায়, মনে হয়, তিনি কোনো নায়ক নন, নন কোনো অভিনয়শিল্পী। তিনি কেবলই একটা চরিত্র, যে চরিত্র আমাদের খুব চেনা।