রুপালি গিটার ফেলে এক বছর

>
আইয়ুব বাচ্চু তাঁর রুপালি গিটার ফেলে চলে গেছেন এক বছর হলো। আগামীকাল ১৮ অক্টোবর তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আইয়ুব বাচ্চু মানে এলআরবি, আইয়ুব বাচ্চু যেন এক গিটারের নাম। চলে যাওয়ার পর কেমন আছে তাঁর ফেলে যাওয়া গিটারগুলো? তাঁর গানের মালিকানাই বা কার হাতে? এলআরবি কি থেমেই থাকবে? কেমন কাটছে তাঁর সহশিল্পীদের দিনকাল? এসবের উত্তর খুঁজেছেন মাসুম আলী

গত বছরের ১৮ অক্টোবর, সকালেই ছড়িয়ে পড়ল খবরটা—আইয়ুব বাচ্চু নেই! বেলা বাড়তেই হাসপাতাল লোকারণ্য। চট্টগ্রামের শেষযাত্রায় জনসমুদ্র। প্রিয় তারকার অন্তর্ধানের পর নিকট অতীতে মানুষের মন এতটা বিষণ্ন খুব কমই হয়েছে। তবে শিল্পীর বেলায় দেহান্তর হলেই তো সব শেষ নয়। ফলে আইয়ুব বাচ্চু প্রতিদিনের চর্চায়, ভক্তের স্মৃতিতে অমলিন। রুপালি গিটার ফেলে তিনি আদতে ঠাঁই নিয়েছেন মানুষের হৃদয়পুরে।

গানের মালিক কে?
নানাভাবে, নানা মাধ্যমে আইয়ুব বাচ্চুর গান রয়ে গেছে। তাঁর গাওয়া কিংবা সুর করা গানের পূর্ণাঙ্গ এবং নিখুঁত তালিকা এখনো হয়নি। তবে কাগজে–কলমে একটা হিসাব আছে। বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে গিয়ে দেখা গেল, মোট ২৬টি অ্যালবাম নিবন্ধন করেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এর মধ্যে ১৩টি তাঁর একক এবং ১৩টি ব্যান্ডের অ্যালবাম। এই ২৬ অ্যালবামের সব গান আইয়ুব বাচ্চুর নিজের নামে নিবন্ধন করা। অর্থাৎ ব্যক্তি আইয়ুব বাচ্চুর নামে, এলআরবি ব্যান্ডের নামে নয়। এর বাইরে তিনটি অ্যালবাম—কষ্ট, ফেরারি মন এবং মন চাইলে মন পাবের কপিরাইট নিয়ে উচ্চ আদালতে প্রযোজনা সংস্থা সাউন্ডটেকের সঙ্গে আইনি লড়াই চলছে।

এই গানগুলোর মালিক শুধু আইয়ুব বাচ্চুর উত্তরাধিকারীরা। রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস (যুগ্ম সচিব) জাফর রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু গানগুলো আইয়ুব বাচ্চু নিজের নামেই নিবন্ধন করেছেন, সেহেতু ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে এসব গানের ব্যবহারের একমাত্র অধিকার তাঁর আইনগত উত্তরাধিকারদের। তাঁর দলের অন্য সদস্যরাও এগুলো বাণিজ্যিকভাবে পরিবেশন করতে পারবেন না।’

এলআরবি কার?
এলআরবির মালিকানার প্রসঙ্গটি এলে আইয়ুব বাচ্চুরই বলা কিছু কথা মনে পড়ে। প্রথম আলোকে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এলআরবি একটি পরিবার। সারা জীবন এ পরিবার থাকবে। আমরা না থাকলেও আমাদের উত্তরাধিকারেরা এই পরিবারে থাকবে। ওরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে এলআরবিকে।’

এ তো গেল মুখের কথা। কাগজ–কলম কী বলে? তা জানতে আবারও কপিরাইট রেজিস্ট্রারের শরণাপন্ন হই। তিনি জানালেন নিয়ম অনুযায়ী কপিরাইট অফিসে কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের লোগো নিবন্ধন হয়। এলআরবিরও তেমন লোগো নিবন্ধন হয়েছে। একই সঙ্গে নামও কপিরাইট অফিসে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এখানেও শুধু আইয়ুব বাচ্চুর নামেই এলআরবির লোগো এবং নাম নিবন্ধন হয়েছে। এ হিসেবে বর্তমানে এলআরবির মালিক শুধু তাঁর উত্তরাধিকারেরা। তাঁদের চাওয়ার ওপর নির্ভর করছে এলআরবির পরবর্তী কার্যক্রম। 

প্রশ্ন জাগে, ব্যান্ডের অন্য সদস্যরা কি কোনো অধিকার রাখেন না? রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস (যুগ্ম সচিব) জাফর রাজা চৌধুরী জানালেন, নিবন্ধনের সময় যদি ব্যান্ডের সদস্যদের মধ্যে অংশীদারত্বের সমঝোতা চুক্তি থাকত, সে ক্ষেত্রে তাঁরাও দাবিদার হতেন। কিন্তু এলআরবির ক্ষেত্রে শুধু আইয়ুব বাচ্চুর নামেই নিবন্ধন হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও ব্যান্ডের অন্য কোনো সদস্য এর দাবিদার নয়। 

আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁর মেয়ে ফাইরুজ সাফরা বলেছিলেন, ‘বাবা সব সময় বলতেন, “আমাকে ছাড়া এলআরবি চলবে না। আমার এই সম্পদের অধিকার শুধু তোমার আর তোমার ভাইয়ের।” বাবা একটা কথা সব সময় পরিষ্কার করে বলতেন, “আমি তোমাদের খুব গরিব বাবা। আমার অনেক সীমিত জিনিস। আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ আমার ছেলে ও মেয়ে। জীবনে অনেক শ্রম দিয়ে তোমাদের লেখাপড়া করিয়েছি।”’

আইয়ুব বাচ্চুর অবর্তমানে তাঁর ব্যান্ডের কী হবে? এই প্রশ্নে ফাইরুজ সাফরা বলেন, ‘বাবা প্রায়ই বলতেন, “আমি না থাকলে, আমার কোনো জিনিস কখনো উল্টাপাল্টা হতে দিয়ো না।”’ এলআরবির সদস্যদের উদ্দেশে ফাইরুজ সাফরা বলেন, ‘তারা শূন্য থেকে নতুন একটি ব্যান্ড গঠন করুক। তাতে আমাদের বাধা দেওয়ার কিছু নেই। যে যেভাবে বাবাকে চায়, ট্রিবিউট জানাতে পারবে, সেখানে আমরা বাধা দেওয়ার কেউ নই।’ আর এলআরবির গান গাওয়ার ব্যাপারে ফাইরুজ সাফরার বক্তব্য, ‘মঞ্চে যে কেউ বাবার গান গাইতে পারবে।’

এই ছবি এখন স্মৃতি। এলআরবি–র সব শেষ লাইনআপ—(বাঁ থেকে) রোমেল, স্বপন, আইয়ুব বাচ্চু, মাসুদ ও শামীম। ছবি: প্র আনন্দ
এই ছবি এখন স্মৃতি। এলআরবি–র সব শেষ লাইনআপ—(বাঁ থেকে) রোমেল, স্বপন, আইয়ুব বাচ্চু, মাসুদ ও শামীম। ছবি: প্র আনন্দ

কেমন কাটছে তাঁদের দিনকাল?
সত্যিকার অর্থে এলআরবি ছিল ‘ওয়ান–ম্যান শো’, অর্থাৎ একক নেতৃত্বের ব্যান্ড। আইয়ুব বাচ্চু নেই, তাঁর এলআরবিও নেই। এটিই রূঢ় বাস্তব। তিনি যেমন রেখে গেছেন অনেকগুলো গান, তেমনই আছেন তাঁর আরেক পরিবার এলআরবির বাকি চার সদস্য। বাস্তবতা হচ্ছে তাঁরা সবাই এখন এলআরবির সাবেক সদস্য। এলআরবির সর্বশেষ লাইনআপ ছিল—আইয়ুব বাচ্চু, স্বপন, মাসুদ, রোমেল এবং ম্যানেজার হিসেবে শামীম। 

এলআরবির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য গিটারিস্ট সাইদুল হাসান। সংগীতই তাঁর পেশা। সাইদুল বলেন, ‘আমার গিটার শেখা শুরু বসের (আইয়ুব বাচ্চু) হাতেই। ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বসের পাশেই ছিলাম।’ ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চু, সাইদুল, জয়, টুটুল মিলে এলআরবির যাত্রা শুরু করেন। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন চুপচাপ ছিলেন সাইদুল। যোগাযোগ ছিল না কারও সঙ্গে। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে নতুন লাইনআপ নিয়ে এলআরবি নতুন যাত্রার ঘোষণা দেন তিনি। নতুন ভোকাল হিসেবে নেন ব্যান্ড তারকা মিজানকে, যিনি এর আগে ওয়ারফেজের মূল ভোকাল ছিলেন। এলআরবির নতুন লাইনআপে আছেন সাইদুল (ব্যান্ড লিডার ও বেজ), পুষ্প ফেরদৌস (গিটার) ও অমিত (ড্রামস)। এই লাইনআপ নিয়ে এলআরবির গানের অনুশীলনের ভিডিও দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যেখানে মিজানকে ‘চাঁদমামা’, ‘ঘুমন্ত শহরে’ ইত্যাদি গান গাইতে শোনা গেছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নতুন এলআরবির আর কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। সাইদুল বলেন, ‘আমি মিউজিক ছাড়া, এলআরবি ছাড়া কখনো কিছু ভাবিনি। কনসার্ট করে, বাজিয়ে আমার সংসার চলত। এখন জানি না কী করব!’

ড্রামার রোমেলকে এ কদিন কোনো কনসার্টে বা সংগীতাঙ্গনের কোনো কার্যক্রমে দেখা যায়নি। এখন তিনি কোনো ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত নন। নিজের কাজকর্ম নিয়ে কোনো মন্তব্য করতেও রাজি হননি। তবে কথা বলেছেন মাসুদ। তিনি বলেন, ‘এখনো আমি বসের সঙ্গে আছি। তাঁর মৃত্যুর পর ভালোভাবে ঘুমাতে পারিনি। বসের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর পর নতুন করে কাজ শুরু করব, নিজেকে ব্যস্ত রাখব।’ মাসুদের একটি গিটারের স্কুল ছিল। এলআরবির কারণে সেখানে সময় দিতে পারেননি এত দিন। চেষ্টা করবেন নিজের গিটারের স্কুলটি নতুন করে চালিয়ে নিতে। 

বয়সে প্রবীণ হলেও এলআরবিতে তুলনামূলক নবীন সদস্য শামীম আহমেদ। ২০১২ সালে ব্যবস্থাপক এবং শব্দ নিয়ন্ত্রক বিশেষজ্ঞ হিসেবে এলআরবির সদস্য হন। তিনি বলেন, ‘নতুন এলআরবির শুরু থেকেই আমাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আমার জন্য অসম্মানের ছিল। কিন্তু এলআরবির এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কোনো রকমের প্রতিবাদ কিংবা অভিযোগ করিনি। আমার নিজের অন্য পেশা আছে। শব্দযন্ত্র সরবরাহ এবং নিয়ন্ত্রণ। এ নিয়েই ব্যস্ত। এলআরবির কোনো বিষয়ে আমি আর নাক গলাব না।’