পরপর উৎসব যেন নাটকের জন্য মুখিয়ে শহর

ডিয়ার লায়ার নাটকের দৃশ্যে আতাউর রহমান ও অপি করিম। ১৯ অক্টোবর স্টুডিও থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
ডিয়ার লায়ার নাটকের দৃশ্যে আতাউর রহমান ও অপি করিম। ১৯ অক্টোবর স্টুডিও থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
>একটি উৎসব শেষ। পরের সন্ধ্যায় আরেক উৎসব। এর মধ্যে মিলল আরও একটি উৎসবের খবর। সব মিলিয়ে ঢাকা যেন এখন নাট্যোৎসবের নগরী। এসব উৎসবের কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন মাসুম আলী

ইদানীং সন্ধ্যার পর সেগুনবাগিচা এলাকার দিকে যাওয়া হয়েছে? কার্তিকের এই সময়ে রাত ১০টার মধ্যে রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সামনে গেলে দেখতে পাবেন, রীতিমতো মেলা বসেছে। অগণিত মানুষের উপস্থিতি সেখানে। এই কোলাহল, এত প্রাণচাঞ্চল্যের একটাই উপলক্ষ—শিল্পকলা একাডেমির ভেতরের নাট্যোৎসব। যদি ভিনদেশি কেউ এই সময়ে শিল্পকলা প্রাঙ্গণে বা এর আশপাশের এলাকায় আসেন, তাহলে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, শহরটা কি তবে নাটকের?

এটা বললে অবশ্য একেবারে ভুল হবে না। একটি ঘটনা দিয়েই না হয় বিষয়টি বুঝিয়ে বলি— রোববার, ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা। আরণ্যকের ময়ূর সিংহাসন নাটকের সেট ততক্ষণে সরানো হয়ে গেছে। খালি মঞ্চ পেছনে রেখে গঙ্গা–যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব–২০১৯–এর আয়োজক পর্ষদের আহ্বায়ক গোলাম কুদ্দুছ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে অনানুষ্ঠানিক সভা করছেন। কেমন হলো উৎসব, কে কেমন দায়িত্ব পালন করেছে, আবার কবে দেখাসাক্ষাৎ হবে, উৎসব–পরবর্তী পুনর্মিলনীতে কাচ্চি থাকবে, না ভাত–ভর্তা—এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে আলাপ। এর মধ্যে ৮–৯ বছর বয়সী এক ছেলে এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘আঙ্কেল, কাল কি উৎসব হবে না?’ জবাবে ‘না’ শুনে মনটা আরও ভার হয়ে গেল জুরাইনের নিলয় খানের। জানলাম, শিশুটির মা–বাবা দুজনই স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে ছিলেন। গত ১০ দিন মা–বাবার সঙ্গে উৎসবে এসেছে সে, নিজেও স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছে। ছেলেটি জানাল, দিনগুলো খুব মজায় কেটেছে তার।

দেখলাম সদ্য শেষ হওয়া গঙ্গা–যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যাটা নেহাত কম ছিল না। জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনের অর্ধেকটা ভরে গেছে। মহিলা সমিতির ওরা তখনো এসে পৌঁছায়নি। কথা প্রসঙ্গে গোলাম কুদ্দুছ জানালেন, দিনে দিনে উৎসবটা যেমন বড় হচ্ছে, তেমনি সংস্কৃতিকর্মীদের অংশগ্রহণও বাড়ছে। কোনো রকমের পারিশ্রমিক ছাড়াই কর্মীরা ১০টা দিন খেটেছেন নেহাতই সংস্কৃতির টানে। শুধু বিকেলে নাশতা হিসেবে পেয়েছেন একটা শিঙাড়া! 

উৎসবে মিশে গেলেন আপামর দর্শক। ছবি: আনন্দ
উৎসবে মিশে গেলেন আপামর দর্শক। ছবি: আনন্দ

তারকা নেই, মন ভরেছে নাটকে

মুখে না বললেও মনে মনে অনেকে ভাবেন বটে ভারত থেকে আসা নাটকের দলগুলোতে চেনামুখ দেখবেন। অন্তত জি–বাংলা বা স্টার জলসায় দেখা চেনা শিল্পীদের দেখা তো মিলবেই। তবে এবারের উৎসবে তেমন তারকামুখ দেখা যায়নি। খুব যে একটা নামকরা দল এসেছে, তা–ও না। তবে এবারের দলগুলো বেশ ভালো প্রযোজনা নিয়ে এসেছে এবং স্থানীয় দর্শকের মধ্যেও ভালো সাড়া ফেলেছে নাটকগুলো।

তেমনই একটি নাটক কোজাগরী। পশ্চিম বাংলার বেলঘরিয়া অভিমুখ নাট্যদলের প্রথম প্রযোজনা। নির্দেশনা দিয়েছেন কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। হাওয়ার্ড ফাস্টের সাইলাস টিম্বারম্যান অবলম্বনে তৈরি হয়েছে কোজাগরী। ১৮ অক্টোবর মিলনায়তনভর্তি দর্শক নাটকটি দেখেছেন। সেদিন রেকর্ড পরিমাণ টিকিটও বিক্রি হয়, এক প্রদর্শনীতেই ৯৮ হাজার টাকা।

আরেকটি নাটকের কথা আলাদা করে বলতে হয়। নাম এলা এখন। ১৯ অক্টোবর শনিবার সন্ধ্যায় পরীক্ষণ থিয়েটার হলে ভারতের বেলঘরিয়ার দল রূপতাপস মঞ্চায়ন করে নাটকটি। এর নির্দেশক কৌশিক ঘোষ। তিনি বলেন, ‘নাটকটি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখি, ১৯৩৪ সালে লেখা নাটকটির সঙ্গে বর্তমান সমাজব্যবস্থা বা রাজনৈতিক পটভূমির তফাত খুব একটা নেই। সময়োত্তীর্ণ এই উপন্যাস তাই আমার বক্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। আমি এটাকে অবলম্বন করেই সাজিয়েছি এলাকে।’ 

নাট্যচক্রের ভদ্দরনোক নাটকের দৃশ্য। ছবি: জিনাত শারমিন
নাট্যচক্রের ভদ্দরনোক নাটকের দৃশ্য। ছবি: জিনাত শারমিন

মায়ের জায়গায় এখন

উৎসবের কল্যাণে দীর্ঘদিন পর দেখা হলো নাট্যচক্রের জনপ্রিয় প্রযোজনা ভদ্দরনোক, ১৯ অক্টোবর শনিবার সন্ধ্যায়। ১৯৮৩ সালের শেষ দিকে ঢাকার মঞ্চে আসে এই নাটক। মলিয়েরের দ্য বুর্জোয়া জেন্টলম্যান অবলম্বনে গোলাম সারোয়ার তৈরি করেছেন ভদ্দরনোক। এটি নাট্যচক্রের ২৭তম প্রযোজনা। নাটকটি দেখে মনে হয়েছে, সময়ের সঙ্গে নাটক নিজেও যেন বুড়িয়ে গেছে। নাটকে অভিনয় করেছেন ম. হামিদ, মাহমুদ সাজ্জাদের মতো জ্যেষ্ঠ শিল্পীরা। নাটকের প্রায় সব দৃশ্যে ম. হামিদের আঙ্গিক, বাচিক উপস্থিতি আছে। ৭০ পার হয়ে মঞ্চে তাঁর এমন উপস্থিতি নিঃসন্দেহে সাহসী উদ্যোগ। মাহমুদ সাজ্জাদের উজ্জ্বল উপস্থিতিও তরুণ অভিনেতাদের প্রেরণা জোগাবে। নাটকের গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তনিমা হামিদ। এ চরিত্রে একসময় অভিনয় করতেন তাঁর মা ফাল্গুনী হামিদ। নির্দেশক গোলাম সারোয়ার জানান, দীর্ঘ বিরতির পর তাঁরা নাটকটি মঞ্চে এনেছেন। এখন চেষ্টা করছেন নিয়মিত করার। খুব শিগগির নাটকটি আবার দেখা যাবে মঞ্চে। 

জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে বাংলা নাট্য উৎসবের উদ্বোধন করেন অতিথিরা। ছবি: শুভ্র কান্তি দাস
জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে বাংলা নাট্য উৎসবের উদ্বোধন করেন অতিথিরা। ছবি: শুভ্র কান্তি দাস

উৎসব শেষে উৎসব শুরু

এক উৎসব থেকে আরেক উৎসবের ব্যবধান মাত্র কয়েক ঘণ্টার। রোববার রাতে যে জাতীয় নাট্যশালা ছিল গঙ্গা–যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের সাজে, সোমবার সন্ধ্যায়ই সেটা বদলে গেল ‘বাংলা নাট্য উৎসব’–এ। ২১ অক্টোবর শুরু হওয়া এ উৎসবের আয়োজক মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়। তাদের প্রতিষ্ঠার তিন যুগ পূর্তি হয়েছে। এ জন্য বছরব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে নানান নাট্য কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছে তারা। এরই ধারাবাহিকতায় এই নাট্যোৎসব। জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনের মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে ১০ দিনের উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি মীর জাহিদ হাসান জানান, বাংলাভাষী ৩১টি নাটক নিয়ে সাজানো হয়েছে বাংলা নাট্য উৎসব।

গতকাল বুধবার থেকে রাজধানীর উপকণ্ঠে দনিয়া স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনেও ছড়িয়ে পড়েছে এই উৎসব। এবারের উৎসবে ভারতের আসাম থেকে ভাবিকাল থিয়েটার, পশ্চিমবঙ্গ থেকে এবং আমরা থিয়েটার ও রঘুনাথগঞ্জ থিয়েটার গ্রুপ আর ত্রিপুরা থেকে এসেছে শুভম নাট্যচক্র ও লারনার্স থিয়েটার। বাংলা নাট্য উৎসব চলবে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত। বাংলাদেশের ২৬টি নাটক ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের ৫টি নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় নাট্যশালায় আছে দেশ নাটকের নিত্যপুরাণ। পরীক্ষণ থিয়েটারে শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র পরিবেশন করবে চম্পাবতী। মহিলা সমিতির মিলনায়তনে ত্রিপুরার লারনার্স থিয়েটার মঞ্চায়ন করবে অমানিশা। দনিয়া স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে নবনাট পরিবেশন করবে জেরা।

আরেক উৎসবের খবর

৩০ অক্টোবর শেষ হবে বাংলা নাট্য উৎসব। মাঝে এক দিন বিরতি। ১ নভেম্বর শুরু হয়ে যাবে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের ৮ম জাতীয় সম্মেলন ও সেলিম আল দীন নাট্য উৎসব। ‘হাতের মুঠোয় হাজার বছর আমরা চলেছি সামনে’ স্লোগানে ১ নভেম্বর শুরু হয়ে চলবে ৩ নভেম্বর রোববার পর্যন্ত। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ জানিয়েছেন, শুক্রবার এ আয়োজনের উদ্বোধন করবেন সারা দেশ থেকে আসা পাঁচ শতাধিক নাট্যকর্মী ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।

ফেসবুক ভরে গেছে নাটক আর আড্ডার ছবিতে

একের পর এক উৎসব চলছে। যা হওয়ার তা–ই হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও উৎসবের আমেজ। যাঁদের বন্ধুতালিকায় সংস্কৃতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা নাট্যানুরাগী আছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই দেখেছেন, ফেসবুক এখন নাট্যোৎসবময়। সহশিল্পীদের সঙ্গে ছবি, নাটকের ছবি, পোস্টার–ব্যানার পাশে রেখে সেলফি; চলছেই।