আজি হতে শতবর্ষ আগে

সিলেটে পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী (বামে) ও অন্য নারীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত
সিলেটে পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী (বামে) ও অন্য নারীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত

সময়টা ১৯১৯ সাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ভারতের শিলংয়ে বেড়াতে এসেছিলেন। তা জানতে পেরে সিলেটের ব্রাহ্মসমাজের তৎকালীন সম্পাদক গোবিন্দ নারায়ণ সিংহ তারবার্তার মাধ্যমে কবিকে সিলেট আসার আমন্ত্রণ জানান। তবে দুর্গম যোগাযোগের কারণে তিনি আসতে রাজি হচ্ছিলেন না। এ অবস্থায় তাঁকে সিলেট আসার অনুরোধ জানিয়ে ‘আঞ্জুমানে ইসলাম’, ‘মহিলা সমিতি’সহ বিভিন্ন সংগঠন টেলিগ্রাম করে।

নানা সংগঠন আর মানুষের অনুরোধে কবিগুরু শেষ পর্যন্ত সিলেট আসার পক্ষে মত দেন। ১৯১৯ সালের ৩ নভেম্বর তিনি আসাম-বেঙ্গল রেলপথে লামাডিং হয়ে সিলেট রওনা হন। কবিগুরুর সফরসঙ্গী ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। পরদিন ৪ নভেম্বর তিনি সিলেটে পৌঁছান। সে হিসাবে কবিগুরুর সিলেট পরিভ্রমণের শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে আজ সোমবার।

গবেষকদের সূত্রে জানা গেছে, যখন সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে কবিগুরু পৌঁছান, তখন বাজি পোড়ানোর পাশাপাশি হর্ষধ্বনিতে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। হাজারো মানুষ স্টেশনে উপস্থিত হয়েছিলেন কবিকে দেখতে। এ তালিকায় বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ছিল। সুসজ্জিত বোটে চেপে রবীন্দ্রনাথ রেলস্টেশন এলাকা থেকে সুরমা নদী পার হয়ে মূল শহরে পৌঁছান। তিনি শহরের পাদরি টমাস সাহেবের বাংলোয় আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। চার দিন সিলেটে কাটিয়ে ৮ নভেম্বর তিনি ভারতের আগরতলার উদ্দেশে সিলেট ছাড়েন।

গোবিন্দ নারায়ণ সিংহের বাসায় সবার সঙ্গে ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীসহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত
গোবিন্দ নারায়ণ সিংহের বাসায় সবার সঙ্গে ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীসহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের ‘রবি জীবনী’ থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ সিলেট পরিভ্রমণকালে মণিপুরি তাঁত ও তাঁদের জীবনযাপনের পাশাপাশি মণিপুরি নৃত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনের নৃত্যকলায় মণিপুরি নৃত্যভঙ্গি যে বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছিল, মূলত এই মুগ্ধতা থেকেই তাঁর সূত্রপাত। কবিগুরু সিলেট সফরকালে তিনটি অভিভাষণ দিয়েছিলেন। এর দুটি টাউন হল প্রাঙ্গণে এবং একটি এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে। এ ছাড়া কবি তখন সিংহবাড়ি, শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজ ও মহিলা সমিতির নানা অনুষ্ঠানেও অংশ নেন।

সিলেটের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কবি তুষার কর বলেন, রবীন্দ্রনাথ সিলেট সফরকালে এ অঞ্চলকে ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ হিসেবে অভিহিত করে একটি কবিতা লিখেছিলেন। যেটি তাঁর প্রয়াণের পর ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে সিলেট থেকে প্রকাশিত কবি-প্রণাম গ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল। সে কবিতায় তিনি বলেছিলেন, ‘মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাঙলার রাষ্ট্র সীমা হতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি।’ সে হিসাবে এ কবিতার বয়সও এখন এক শ। কবিগুরু যেদিন সিলেট পৌঁছেছিলেন, সেদিন সন্ধ্যা সাতটায় শ্রীহট্ট ব্রাহ্মমন্দিরে উপাসনায় অংশ নিয়ে গেয়ে শুনিয়েছিলেন ‘বীণা বাজাও হে মম অন্তরে’ গানটি। কবিগুরুর সিলেট সফর সত্যিকার অর্থেই সিলেটবাসীর গর্ব করার মতো একটি বিষয়।

সিলেটে মুরারি চাঁদ কলেজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কয়েকজন ছাত্র। ছবি: সংগৃহীত
সিলেটে মুরারি চাঁদ কলেজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কয়েকজন ছাত্র। ছবি: সংগৃহীত

কবিগুরুর সিলেট পরিভ্রমণের শতবর্ষ পূর্তিকে ঘটা করে পালন করতে গঠিত হয়েছে ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ: শতবর্ষ স্মরণোৎসব পর্ষদ’। এর আহ্বায়ক সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সদস্যসচিব সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সদস্যসচিব আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত কবিগুরুর সিলেট পরিভ্রমণের মুহূর্তগুলো খুবই বর্ণিলভাবে উদ্‌যাপিত হবে। এতে দেশ-বিদেশের শিল্পী, গবেষক ও রবীন্দ্র-অনুরাগীরা অংশ নেবেন।