নাটকে দেশভাগের যন্ত্রণা

‘আমার মুখের আঁচলখানি’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘আমার মুখের আঁচলখানি’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

গল্পটা দেশভাগের। মাতৃত্ব ও ভূমিহারার পরিচয়সংকট আর যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত। রঙ্গাশ্রম বহরমপুরের নতুন নাটক সন্দীপ ভট্টাচার্যের ‘আমার মুখের আঁচলখানি’ এমনই এক নাটক, যার বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, এক শিল্পীর জীবন ও শিল্পের ক্রন্দন। আর ‘আমার মুখের আঁচলখানি’ হলো দেশভাগের ফলে মরতে মরতে বেঁচে ওঠা এক নারী ও অভিনেত্রীর জীবন, যিনি দেশভাগের শিকার। 


‘আমার মুখের আঁচলখানি’ নাটকটি মঞ্চস্থ হলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায়। বটতলার আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ‘বটতলা রঙ্গমেলা ২০১৯’ দ্বিতীয় দিনের আয়োজনে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। ভারতের বহরমপুরের নাটকের দল রঙ্গাশ্রমের পরিবেশনায় নাটক ‘আমার মুখের আঁচলখানি’। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সন্দীপ ভট্টাচার্য। নাট্যকার মহেশ দত্তানির ‘হোয়্যার ডিড আই লিভ মাই পুরদা’র বাংলায় নাট্যরূপ দেন অংশুমান ভৌমিক। ‘আমার মুখের আঁচলখানি’ শিরোনামটি রবীন্দ্রনাথের গান থেকে নেওয়া।

‘নৃশংস নৈঃশব্দ্য ভেঙে সুনন্দ সাহস জাগুক প্রাণে প্রাণে’ স্লোগান নিয়ে গত শুক্রবার আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে শুরু হয়েছে বটতলা রঙ্গমেলা ২০১৯। গতকাল রঙ্গমেলার দ্বিতীয় দিন। এদিন সন্ধ্যা ছয়টায় নাদিম মঞ্চে চট্টগ্রামের গানের দল ‘ক্ষ্যাপা বাউল’-এর পরিবেশনায় ছিল ‘সহজ গানের সন্ধ্যা’ শীর্ষক আসর। এরপর রঙ্গমঞ্চে সন্ধ্যা সাতটায় বিভাগীয় সম্মাননা দেওয়া হয়। বিভাগীয় সম্মাননার সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে বরিশাল বিভাগের খান দেলোয়ার হোসেনকে। তাঁর হাতে সম্মাননা পদক তুলে দেন নাট্যজন ইনামুল হক।

‘আমার মুখের আঁচলখানি’ হলো দেশভাগের ফলে মরতে মরতে বেঁচে ওঠা এক নারী ও অভিনেত্রীর জীবন। ছবি: সংগৃহীত
‘আমার মুখের আঁচলখানি’ হলো দেশভাগের ফলে মরতে মরতে বেঁচে ওঠা এক নারী ও অভিনেত্রীর জীবন। ছবি: সংগৃহীত

এরপর শুরু হয় নাটক। রঙ্গাশ্রমের পরিবেশনায় নাটক ‘আমার মুখের আঁচলখানি’। এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রবীণ নাজিয়া একজন ব্যস্ত অভিনেত্রী। গেঁটে ব্যথা, মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া রোগ আছে তাঁর। থিয়েটারই প্রথম প্রেম, কিন্তু দল এবং জীবিকার প্রয়োজনে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, এখন আবার সিরিয়ালে ঠাকুমার ভূমিকা ছাড়া জোটে না কোনো চ্যালেঞ্জিং রোল। এমন একটা বয়সে এসে তিনি ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলাম’ নামাতে চান নতুন আঙ্গিকে। যে ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলাম’জুড়ে পড়ে রয়েছে তাঁর অতীত। এই নাটকে শকুন্তলা চরিত্রের জন্য অডিশন চালাচ্ছেন তিনি, মনে ধরছে না কাউকে। যে অতীতকে তিনি ভুলে যেতে চেয়েছেন, সেগুলোই যেন বারবার সেই শকুন্তলার মধ্য দিয়ে, জীবনের বাস্তবতার মধ্য দিয়ে ফিরে আসতে থাকে। এটা যেন প্রকৃত শিল্পীর ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই—কোনো প্রতিবন্ধকতাই আটকে রাখতে পারে না থিয়েটারপাগল নাজিয়াকে। নাটকে নাজিয়া চরিত্রে অভিনয় করেছেন রত্না ভট্টাচার্য। আরও অভিনয় করেছেন সোমা দাস, রণিতা লাহিড়ী, সুষমা দেব, দেবলীনা ভট্টাচার্য, রাজেশ দেব, রাজেশ সাহা প্রমুখ।

নাটক শেষে খান দেলোয়ার হোসেন রঙ্গাশ্রমের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন। এ বছর উৎসবে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে ‘অন্তরালের সম্মাননা’ প্রদানের মাধ্যমে। নাটক শেষে অন্তরালের সম্মাননা পদক দেওয়া হয় আলোক বিভাগ থেকে আবদুল মালেক মিয়াকে। তাঁর হাতেও পদক তুলে দেন বিভাগীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত নাটকের বাতিঘর খান দেলোয়ার হোসেন।

এরপর রঙ্গমঞ্চেই শুরু হয় রঙ্গ আড্ডা। মোহাম্মদ আলী হায়দারের উপস্থাপনায় এ আড্ডায় ‘আমার মুখের আঁচলখানি’ নাটকের নির্দেশক সন্দীপ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দর্শকেরা নাটক নিয়ে আড্ডায় মেতে ওঠেন।

ভারতের বহরমপুরের নাটকের দল রঙ্গাশ্রমের পরিবেশনায় নাটক ‘আমার মুখের আঁচলখানি’। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের বহরমপুরের নাটকের দল রঙ্গাশ্রমের পরিবেশনায় নাটক ‘আমার মুখের আঁচলখানি’। ছবি: সংগৃহীত

তৃতীয়বারের মতো আয়োজিত এ উৎসব চলবে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত। ১১ দিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে প্রতিদিন মূল রঙ্গমঞ্চে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে বটতলাসহ বাংলাদেশের দুটি ও বিদেশের আটটি দল নাটক পরিবেশন করছে। বাংলাদেশ ছাড়া উৎসবে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো হচ্ছে ভারত, স্পেন, ইরান ও নেপাল। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বহিরাঙ্গনে নাদিম মঞ্চে থাকছে নাটক, গান, কবিতা, নাচসহ বিভিন্ন আনন্দ আয়োজন। গত বছরের মতো এবারও থাকছে দেশের আটটি বিভাগের আট নাট্যজনকে সম্মাননা প্রদান, যাঁরা খুব নীরবে দীর্ঘদিন ধরে নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং করছেন। সম্মাননার তালিকায় আছেন দেলোয়ার হোসেন (বরিশাল), হেমেন্দ্র চৌধুরী (সিলেট), হরিপদ সূত্রধর (ঢাকা), সবিতা সেনগুপ্ত (রংপুর), গৌরাঙ্গ আদিত্য (ময়মনসিংহ), মিলন চৌধুরী (চট্টগ্রাম), অনিতা মৈত্র (রাজশাহী) ও রোহানি বেগম মেরী (খুলনা)।

ইতিমধ্যে উৎসবে ‘ক্রাচের কর্নেল’ (বটতলা, বাংলাদেশ), ‘আমার মুখের আঁচলখানি’ (রঙ্গাশ্রম, ভারত) মঞ্চস্থ হয়েছে। আগামী দিনগুলোয় মঞ্চস্থ হবে ‘ডিলেমাস উইথ মাই ফ্লেমেনকো টেইলকোট’ (মুন পেলেস, স্পেন), ‘মিস্টিরিয়াস গিফট’ (ক্রেজি বডি গ্রুপ, ইরান), ‘৪.৪৮ সাইকোসিস’ (আরোহণ গুরুকুল, নেপাল), ‘বিল্বমঙ্গল’ (চাকদহ নাট্যজন, ভারত), ‘ম্যাকবেথ’ (পদাতিক নাট্য সংসদ, বাংলাদেশ), ‘শুক’ (জলপাইগুড়ি কলাকুশলী, ভারত), ‘ব্ল্যাক হোল’ (জ্যোতি ডোগরা, ভারত), ‘আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র’ (সুখচর পঞ্চম, ভারত) ও ‘খনা’ (বটতলা, বাংলাদেশ)। প্রতিদিন নাটক শেষে পর্দার অন্তরালে থাকা থিয়েটারের অপরিহার্য কুশলীদের জানানো হবে সম্মান।

নাটক মঞ্চায়নের পর প্রতিদিন বহিরাঙ্গনে নাদিম মঞ্চে রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টায় দর্শকের মুখোমুখি হন সংশ্লিষ্ট নাটকের নির্দেশক। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটা পর্যন্ত গান, নাটক, কবিতা ও নাচে অংশ নেবে মণিপুরী থিয়েটার, ক্ষ্যাপা বাউল, জবিরঙ্গ, সমগীত, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, এফ মাইনর, ঢাকা থিয়েটার, মাদল, সর্বনাম, জাককানইবি নাট্যকলা ও পরিবেশনা বিভাগ এবং বেতালের শিল্পীরা।

শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের গানের দল ‘ক্ষ্যাপা বাউল’-এর পরিবেশনায় ছিল ‘সহজ গানের সন্ধ্যা’ শীর্ষক আসর। ছবি: সংগৃহীত
শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের গানের দল ‘ক্ষ্যাপা বাউল’-এর পরিবেশনায় ছিল ‘সহজ গানের সন্ধ্যা’ শীর্ষক আসর। ছবি: সংগৃহীত

২৬ নভেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় অনুষ্ঠিত হবে ‘রঙ্গমঞ্চে বটতলার আলাপ’। এতে নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী অংশ নেবেন। বিভাগীয় নাট্যজন সম্মাননা প্রদান করা হবে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায়।

উৎসবের সুমন মঞ্চে দেখানো হবে চারটি তথ্যচিত্র। ২১, ২২ ও ২৩ নভেম্বর বেলা সাড়ে তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দেখানো হবে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ (তাপস সেন, ভারত), ‘ফেরদৌসী মজুমদার’ (বাংলাদেশ) এবং ‘বিহাইন্ড দ্য কার্টেন বিভাস চক্রবর্তী’ (ভারত)। ২৪ নভেম্বর দেখানো হবে ‘দ্য টিচার: সৈয়দ জামিল আহমেদ’ (বাংলাদেশ)। সুমন মঞ্চে ২১, ২২ ও ২৩ নভেম্বর বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত তিনটি মাস্টারক্লাস অনুষ্ঠিত হবে। সংগীত ও নাট্য বিষয়ে ক্লাস নেবেন শিমূল ইউসুফ, চিত্রকলা ও নাট্যশিল্প নিয়ে বলবেন ঢালী আল মামুন এবং শরীর, নৃত্য ও প্রশ্ন নিয়ে মাস্টারক্লাসে থাকবেন শৈবাল বসু (ভারত)।

‘হৃদয়ঙ্গম ঋদ্ধ’ মঞ্চে থাকছে শিশুপ্রহর। ২২ ও ২৩ নভেম্বর সকাল ১০টা থেকে শিশুপ্রহরে মঞ্চস্থ হবে ‘আওয়ার কিংডম’ (শব্দাবলী, বরিশাল), ‘পুঁথিপড়া’, ‘পাখিপড়া’ (ফুলকি, চট্টগ্রাম) ও পুতুলনাচ (বাংলাদেশের পুতুল নাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র)। এ ছাড়া দুদিনই থাকবে আর্ট ক্যাম্প। ক্যাম্পে উপস্থিত থেকে শিশুদের উৎসাহিত করবে ‘সিসিমপুর’। ২৬ নভেম্বর রাত নয়টায় উৎসবের পর্দা নামবে।