এইচবিওর পর্দায় কে এই দীপ?

সুদীপ বিশ্বাস দীপ। ছবি: খালেদ সরকার
সুদীপ বিশ্বাস দীপ। ছবি: খালেদ সরকার

১১ নভেম্বর ট্রেনে বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন সুদীপ বিশ্বাস দীপ। হঠাৎ সিঙ্গাপুর থেকে পরিচালকের ফোন। মুক্তি পেয়েছে ‘এইচবিও এশিয়া’ অরিজিনালের ওয়েব সিরিজ ইনভিজিবল স্টোরিজ–এর নির্মাণের গল্প নিয়ে বানানো প্রোমো। সেই প্রথম এই সিরিজে নিজেকে দেখলেন দীপ। তখন কেমন লাগল? ‘বলতে পারব না। শব্দ দিয়ে বলে বোঝানো যাবে না। অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল।’

হাঁটি হাঁটি পা পা করে শুরু হলো পথচলা

ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসতেন। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বড়বেলায় বদলে গেল সেই স্বপ্ন। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পড়তে এসেছিলেন। স্বপ্ন, বিনোদনের দুনিয়ায় ‘কিছু একটা’ করার। ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিষয়ে ভর্তি হলেন। সেই সঙ্গে ভর্তি হলেন প্রাচ্যনাটে। চারুকলা থেকে প্রাচ্যনাটেই সময় দিচ্ছিলেন বেশি। সেখানে অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম যখন মঞ্চের ওপর সবাইকে অভিনয় করাতেন আর শেখাতেন, তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতেন সুদীপ। তেমনই একদিন ভালোবেসে ফেলেছিলেন অভিনয়কে। ঠিক করেছিলেন, অভিনয় করেই জীবিকা নির্বাহ করবেন।

মঞ্চ, ছোট পর্দা আর বড় পর্দায়

২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন প্রাচ্যনাটের সঙ্গে। সেখানে ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি নামের একটি মঞ্চনাটকে তিনি মূল চরিত্র পোশাকশিল্পের কর্মীর শ্বশুর, শাশুড়ি, প্রেমিকসহ মোট ১২টি চরিত্রে দীর্ঘদিন অভিনয় করেছেন। ছোট পর্দায় ওয়াহিদ তারেক পরিচালিত ডকু–ফিকশন অপারেশন কিলোবাইট, শাফায়েত মনসুর পরিচালিত আমার নাম মানুষ, ক্যাফে ৯৯৯ আমরা ফিরব কবে উল্লেখযোগ্য। বড় পর্দায় দীপকে দেখা গেছে দুবার। প্রসূন রহমান পরিচালিত সুতপার ঠিকানা ও রায়হান রাফি পরিচালিত দহন ছবিতে। সামনে মিশন এক্সট্রিম–এও পাওয়া যাবে তাঁকে।

যেভাবে এইচবিও চিনল বাংলাদেশের দীপকে

রুহুল রবিন খান পরিচালিত আইডেন্টিটি নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হয় সিঙ্গাপুরের একটি চলচ্চিত্র উৎসবে। সেখানেই উপস্থিত ছিলেন ইনভিজিবল স্টোরিজ–এর কাস্টিং ডিরেক্টর ও এইবিও কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের এপ্রিলে তাঁরা যোগাযোগ করেন দীপের সঙ্গে। এই সিরিজের একটি চরিত্রের চারটি দৃশ্য তাঁরা পাঠান এই বাংলাদেশি শিল্পীর কাছে। তাঁরা বলে দেন, প্রতিটি দৃশ্য দুই রকম ঢঙে অভিনয় করে মোট আটটি ভিডিও পাঠাতে হবে। চিত্রনাট্য পড়ে অভিভূত হয়ে পড়েন দীপ। পরিচালক ও চিত্রগ্রাহক রিপন চৌধুরীর সহায়তায় ভিডিও ধারণ করেন। সেই ভিডিও মনে ধরে ইনভিজিবল স্টোরিজ–এর পরিচালক ও প্রযোজকদের।

ইনভিজিবল স্টোরিজ–এর দৃশ্য
ইনভিজিবল স্টোরিজ–এর দৃশ্য

‘সিংলিশ’ শিখলেন যেভাবে

সিঙ্গাপুরে দীপের দুজন বন্ধু নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেছেন। প্রথম দুদিনের শুটিং শেষে পাঁচ দিনের ছুটি পেয়ে তিনি প্রথমেই দেখা করেন ওই দুই বন্ধু তরিকুল আর সুমনের সঙ্গে। খেয়াল করে দেখলেন, বন্ধু যখন ফোনে কথা বলে, সেই ‘টোন’ অন্য রকম শোনায়। কথা বলার ওই ঢঙের নাম সিংলিশ। সহজভাবে বলা যায়, এটা হলো সিঙ্গাপুরের মানুষের ইংরেজি বলার ঢং। দীপের ভাষায়, ‘সুমনের ওভাবে ফোনে কথা বলা শুনেই আমার মনে হলো আমার চরিত্রটা তো পাঁচ–ছয় বছর ধরে সিঙ্গাপুরে আছে। তারও এভাবে কথা বলা জানতে হবে। তাই বন্ধুকে ধরে আমার পুরো স্ক্রিপ্ট ওই টোনে রেকর্ড করে নিলাম। সেটা শুনলাম। কয়েকবার আওড়ালাম। বন্ধুরা মিলে খেতে গেলাম। সেখানে আমি সিংলিশ ঢঙে খাবার অর্ডার করলাম। ওরা দুজন রীতিমতো অবাক। প্রশ্ন করে বসল, “এত দ্রুত, এত নিখুঁতভাবে কীভাবে পারলি?”’

সিঙ্গাপুরের দিনগুলো

সিঙ্গাপুরের ছয়টি ক্ষেত্রের ছয়জন মানুষের জীবন নিয়ে ইনভিজিবল স্টোরিজ। ছয় পর্বে দেখা যাবে এটি। এতে দীপ অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের এক নির্মাণশ্রমিকের চরিত্রে। এই সিরিজে তিনি ইংরেজি, বাংলা, চীনা আর সিংলিশ ভাষায় কথা বলেছেন। এই সিরিজে দীপের প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ইন্দোনেশীয় সংবাদ উপস্থাপক, অভিনয়শিল্পী ও নৃত্যশিল্পী সেকার সারি। ৫ জানুয়ারি থেকে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এইচবিওতে দেখানো হবে এই সিরিজ। প্রথম দেখায় পরিচালক জানিয়েছিলেন, ‘তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। বিশেষ করে তোমার চোখ। শিশুর মতো নিষ্পাপ আর গভীর। ঠিক যেমনটা আমার চরিত্রের।’

শুটিং হয়েছে চলতি বছরের জুন–জুলাই মাসে। সিঙ্গাপুরে দীপ যেখানেই গেছেন, লোকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আপনি ভারতীয়?’ সুদীপ জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশ থেকে গিয়েছেন অভিনয় করতে। তখন সুদীপের দিকে অন্যভাবে তাকিয়েছেন ওই মানুষগুলো। সে দৃষ্টিতে ছিল বাংলাদেশের জন্য বিস্ময় আর শ্রদ্ধা। প্রোমো বের হওয়ার পর সেখানে বাংলাদেশের দীপকে দেখে তাঁর বন্ধু, আত্মীয়, শিক্ষক আর এই ইন্ডাস্ট্রির সবাই যত মন্তব্য, যত খুদে বার্তা পাঠিয়েছে, তার মানে একটাই, সুদীপ সবাইকে গর্বিত করেছেন।

এই সিরিজের শতকরা ৮০ ভাগ কলাকুশলীই নাকি নারী। শুটিংয়ে দীপের সঙ্গে সব সময় একজন সহকারী পরিচালক থাকতেন। তাঁর কাজ ছিল দীপকে সবকিছুর আপডেট জানানো, তাঁকে শুটিং স্পটে নিয়ে যাওয়া। তো যাওয়ার পথে ওই সহকারী পরিচালক ফোনের দিকে তাকিয়ে পথ চলছেন। এই ফাঁকে দীপ হাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে পরিচালককে জানানো হলো দীপকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সহকারীর ফোনে পরিচালক উল্টো ফোন করে জানালেন, দীপ শুটিংয়ে চলে এসেছেন। এ রকম অসংখ্য মজার ঘটনা সোনালি মুহূর্ত হয়ে জড়ো হয়েছে দীপের স্মৃতির ফ্রেমে। তবে দিন শেষে পরিচালক লার জিয়ান দীপকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, ‘দীপ, আই অ্যাম লাকি টু হ্যাভ ইউ।’