শেষ হলো বটতলা রঙ্গমেলা ও নাট্যোৎসব
সিংহলের রাজকন্যা খনা, যার আরেক নাম লীলাবতী। তিনি জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী নারী। খনার সেই উপকথাকে নাট্যরূপ দিয়ে নাট্যদল বটতলা প্রথম মঞ্চে আনে ২০১০ সালের ৯ মার্চ। বহুদিন ধরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে এই নাট্যদল মঞ্চস্থ করে আসছে নাটক ‘খনা’। ইতিমধ্যে কাহিনি ও নাট্য আঙ্গিকের জন্য বেশ দর্শকপ্রিয়তাও অর্জন করেছে নাটকটি। গতকাল মঙ্গলবার এই নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ১১ দিনব্যাপী ‘বটতলা রঙ্গমেলা ২০১৯ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব’। আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত উৎসবের শেষ দিনে বটতলা আজীবন সম্মাননা ২০১৯ পেলেন খ্যাতিমান অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক ও সংগঠক মামুনুর রশীদ।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটায় তথ্যচিত্র ‘মঞ্চসারথী: আতাউর রহমান’ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসবের শেষ দিন। তারপর বিকেল পাঁচটায় ছিল ‘নৃশংস নৈঃশব্দ্য কালে সুনন্দ সাহসের থিয়েটার’ শিরোনামে ‘বটতলা’র আলাপ-৫। আশিস গোস্বামীর সঞ্চালনায় বটতলার আলাপে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের নাট্যজন অসিত বসু এবং কামালউদ্দিন কবির। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক শফি আহমেদ।
সন্ধ্যা ছয়টায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের পরিবেশনায় ছিল পারফরম্যান্স আর্ট ‘ছায়া’। এরপর সন্ধ্যা সাতটায় বটতলা আজীবন সম্মাননা ২০১৯ প্রদানের পরপরই শুরু হয় বটতলার নাটক ‘খনা’। ‘খনা’ নাটকটি লিখেছেন সামিনা লুৎফা নিত্রা ও নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। গতকাল নাটকটির ৭২তম মঞ্চায়ন হলো।
‘খনা’ নাটকটি বিদুষী ‘খনা’, যার অন্য নাম লীলাবতী, তাঁকে কেন্দ্র করে। তাঁর গল্পটা অনেক পুরোনো, কিংবদন্তির ঘেরাটোপে বন্দী। তবু যেটুকুর তল খুঁজে পাওয়া যায়, তাতে বোধ হয় যে তিনি এক বিদুষী জ্যোতিষী, স্বামী মিহিরও একই বৃত্তিধারী। শ্বশুর যশস্বী জ্যোতিষী বরাহ মিহির। পুত্রজায়ার যশ, খ্যাতি ও বিদ্যার প্রভাব দর্শনে বরাহের হীনম্মন্যতা ও ঈর্ষা। শ্বশুরের নির্দেশে লীলাবতীর জিহ্বা কর্তন ও তাঁর ‘খনা’ হয়ে ওঠার গল্প পেরিয়েছে প্রজন্মের সীমানা। খনার বচনের মধ্যে টিকে থাকা শত বছর আগের জল, মাটি, ফসল আর মানুষের গন্ধমাখা জ্ঞান আর সত্যটুকু কি সত্যি লীলাবতীর? নাকি এ সত্য-তথ্য সবই এই ভূখণ্ডের বৃষ্টি, পলি আর জল হাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকা যুগান্তরের সামষ্টিক জ্ঞানের সংকলন? লীলাবতী শুধুই কি একজন নারী বলে তাঁর পরিণতি নির্মম? খনার সত্য শুধু থেকে যায় কৃষকের মুখে। তবু প্রশ্ন থাকে, খনার সত্যই কি একক সত্য? নাকি আজকে নির্ভুল যা, কাল তা হতে পারে অসত্য? শুধু সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর যে মৃত্যুনেশা তাঁর, সে নেশা কি একরোখা জেদ? খনা নিজেই নিজেকে করেন সম্মুখীন প্রশ্নের। নাটকে এসব প্রশ্নই উঠেছে বারবার।
‘খনা’ মঞ্চায়নের পর রঙ্গ আড্ডা শেষে এই উৎসবের শেষ সম্মাননা বটতলা অন্তরালের সম্মাননা দেওয়া হয় মঞ্চ সহকারী মো. মনির হোসেনকে এবং এর মধ্য দিয়েই বটতলা রঙ্গমেলা ২০১৯-এর সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
‘নৃশংস নৈঃশব্দ্য ভেঙে সুনন্দ সাহস জাগুক প্রাণে প্রাণে’ স্লোগান নিয়ে আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় উৎসবটি শুরু হয়েছিল। এই আয়োজনে বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, স্পেন, ইরান ও নেপালের নাটকের দল অংশ নিয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বহিরাঙ্গনে নাদিম মঞ্চে ছিল নাটক, গান, কবিতা, নাচসহ বিভিন্ন আনন্দ আয়োজন। গত বছরের মতো এবারও ছিল দেশের আটটি বিভাগের আট নাট্যজনকে সম্মাননা প্রদান, যাঁরা খুব নীরবে দীর্ঘদিন ধরে নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং করছেন।