সৃজনকর্মে রবিউল হুসাইন ছিলেন সতত চলমান
‘রবিউল ভাই যে পরিমাণে কাজ করেছেন, সেই পরিমাণে তাঁর কাজের মূল্যায়ন হয়নি। যে পরিমাণে কাজ করেছেন, তা সঠিকভাবে প্রকাশিত হয়নি। রবিউল ভাইয়ের এখনো যে পরিমাণ লেখা আছে, তা দিয়ে আরও দশখানা বই অনায়াসে বের করা যায়। একটা কথা উঠেছে, বাংলা একাডেমি যেন তাঁর রচনাবলি বের করে। আমরা দায়বদ্ধ তাঁর রচনাবলি বের করার জন্য।’
কবি রবিউল হুসাইনের স্মরণসভায় এসে এ মন্তব্য করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি রবিউল হুসাইনের রচনাবলি প্রকাশ করতে সেসব অপ্রকাশিত লেখাগুলো বাংলা একাডেমিকে দিতে তিনি পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে অনুরোধ করেন।
রবিউল হুসাইনকে নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আজ বিকেলে এই নাগরিক স্মরণসভার আয়োজন করে জাতীয় কবিতা পরিষদ। লাইসা আহমেদ লিসার কণ্ঠে ‘সমুখে শান্তিপারাবার—/ ভাসাও তরণী হে কর্ণধার...গান দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। তারপর বিশিষ্টজনেরা স্মৃতিচারণা শুরু করেন। এতে বক্তারা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পুরোভাগে থেকে ‘সাহসী’ মানুষ হয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাওয়া কবি রবিউল হুসাইনকে তাঁর কর্মে, সৃজনে স্মরণের প্রত্যয় জানালেন। শনিবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে জাতীয় কবিতা পরিষদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় কবি রবিউল হুসাইনের নাগরিক স্মরণসভা।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফের সঞ্চালনায় কবি তারিক সুজাত পাঠ করেন প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের লেখা শোকপত্র। এতে তিনি বলেন, ‘তাঁর সান্নিধ্য সবার জীবনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা, তাঁর কাছে সহজিয়া মানুষ পেয়েছে নির্ভরতা। ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত তাঁর বাঙালি সত্তা, অন্যদিকে বাঙালির নবজাগরণে তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী। তিনি আমাদের প্রেরণা, মানবতা, স্বদেশপ্রেম ও সৃজনের দীক্ষাদাতা।’
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ তাঁর ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘তখন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদদের জয়জয়কার। বাংলা কবিতার পালাবদলের সময়। সে সময় রবিউল ভাইয়ের কবিতাগুলো আমার কাছে বিস্ময়কর উপস্থাপন মনে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সংকটকালে সেনাশাসন, স্বৈরশাসনের সময়ে ছাত্র আন্দোলনে তিনি ছিলেন সোচ্চার। পরে জাতীয় কবিতা পরিষদের আন্দোলনে তিনি শক্তি জুগিয়েছেন। আমাদের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি ছিলেন আমাদের প্রেরণা। তাঁর কবিতার শরীর ও ভাষারীতি ছিল অন্য কবিদের থেকে আলাদা, যা তাঁকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।’
কবি কামাল চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সকলেই নিজের মধ্যে চেতনাবোধশূন্য নিয়ে আছি, কবি রবিউল হুসাইন তেমনি আরও এক শূন্যতা দিয়ে গেলেন।’ কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘কবি রবিউল হুসাইন ছিলেন অজাতশত্রু। তিনি নিজে কত বড় ছিলেন, তা তাঁর আন্দাজেও ছিল না। বিনয়ই ছিল তাঁর বড় অহংকার। সৃজনকর্মে রবিউল হুসাইন ছিলেন সতত চলমান।’
রবিউল হুসাইনের অপ্রকাশিত লেখাগুলো প্রকাশের কথা জানান নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামও। স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘আমি ১৯৬৭ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে কানাডা থেকে ঢাকায় ফিরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেক্স ভবনে তখন আড্ডা বসত। এই আড্ডার বেশির ভাগ ছিলেন কবি, স্থপতি। আমি একেবারেই কবি নই, কবিতার পাঠক। রবিউল আমাকে বললেন, আপনাকে না পত্রিকায় কিছু একটা লিখতে হবে। আমি ঠিক করলাম, একটি গল্প দেব এবং সেটা ছাপা হয়েছিল। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই, আমার ৭৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সংকলন বের হয়। আমার ওপরে রবিউল লিখেছিলেন আমার সেই গল্পেরই শিরোনাম দিয়ে।’ তিনি বলেন, ‘সৃষ্টি ও নির্মাণকে জোড়া লাগিয়ে তিনি গতিপথ বদলে দিয়ে তাঁর মতো করে কাজ করতে চেয়েছিলেন। স্থাপত্যশিল্পের মধ্য দিয়ে তিনি কবিতা ও শিল্পচৈতন্যকে প্রসারিত করেছিলেন।’
কবি কামাল চৌধুরী বলেন, ‘কবির কাজ অন্বেষণ। তাই তাঁকে কখনো কখনো স্থপতিও হতে হয়। রবিউল হুসাইন ছিলেন তেমনি একজন। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি।’ চিত্রশিল্পী হাশেম খান বলেন, ‘আমার সঙ্গে তাঁর ছিল ৪০ বছরের সম্পর্ক। আমরা একসঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, ঢাকা নগর জাদুঘর, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা জাদুঘরের কাজ করেছি।’
হাশেম খান আরও বলেন, ‘রবিউল হুসাইন চিত্রকলা নিয়ে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে মন্তব্য করতেন। তিনি কত বড় স্থপতি, সংগঠক, কবি, সে কথা বলব না, বলব তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর পাশাপাশি থেকেছি। তাঁর সঙ্গী হয়েছি। তাঁর কাছ থেকে আমি নিয়েছি, তিনি আমার কাছ থেকে নিয়েছেন। আমরা একে অপরের পরিপূরক ছিলাম। আমি শুধু বলব, আমি একজন ভালো মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলাম।’
কবির ছেলে জিসান হুসাইন, বোন বিউটি হুসাইন, ভাই তারিক হুসাইন, কবির ভাগনে অর্ণব হাসান, কবি কাজী রোজী, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি জালাল আহমেদ প্রমুখ শোকসভায় কবির স্মৃতিচারণা করেন।
শোকসভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ। স্মরণসভার পরে কবি রবিউল হুসাইনের কবিতা পাঠ করেন কবি ও আবৃত্তিশিল্পীরা।
রবিউল হুসাইন রক্তের সংক্রমণে ভুগছিলেন। দুই সপ্তাহ ধরে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত সোমবার তাঁকে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। সেখানেই ২৬ নভেম্বর শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
রবিউল হুসাইন একাধারে স্থপতি, কবি, শিল্প-সমালোচক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী ছিলেন। পেশা স্থাপত্যশিল্প হলেও সম্পৃক্ত ছিলেন বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষকও ছিলেন তিনি। ভাষা ও সাহিত্যে অবদান রাখায় ২০১৮ সালে একুশে পদক পান এই কবি।
১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ঝিনাইদহের শৈলকুপার রতিডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রবিউল হুসাইন। কুষ্টিয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে তিনি ভর্তি হন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির (বর্তমান বুয়েট) আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টিতে। ১৯৬৮ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং স্থপতি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।