নেটফ্লিক্সের ঢালে ডিজনির তলোয়ার

শুরুতে ‘একলা চলো রে’ মন্ত্র জপে নতুন পথে হেঁটেছে নেটফ্লিক্স। বিস্তর বাধা যেমন একা সামলাতে হয়েছে, তেমনি লাভের গুড়ও নেটফ্লিক্স একাই খেয়েছে। কিন্তু এখন সেই গুড়ে ভাগ বসাতে এসে গেছে ডিজনি, অ্যাপল, আমাজন—আরও কত কী! ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসায় ‘একলা চলার’ সেই পথ এখন যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয়েছে, যার পোশাকি নাম ‘স্ট্রিমিং ওয়ার’।

ডিজনি প্লাস এসেই বাজিমাত

যুদ্ধের শিঙা বাজিয়েছে ডিজনি। গত ১২ নভেম্বর ‘ডিজনি প্লাস’ নামে ভিডিও স্ট্রিমিং সেবা নিয়ে এসেছে এই হলিউড প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। শুধু এক দিনেই এক কোটি গ্রাহক পেয়েছে ডিজনি প্লাস। অবস্থা এমন হয়েছিল যে সার্ভার সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল ডিজনি কর্তৃপক্ষকে। ডিজনি জানিয়েছে, এক দিনে এত বিপুল গ্রাহক পাওয়া কল্পনাতীত বিষয়।

পিছিয়ে নেই অ্যাপল

ডিজনির এই শিঙা বাজানোয় যোগ্য সংগত দিচ্ছে টেকজায়ান্ট প্রতিষ্ঠান অ্যাপল। নভেম্বরের শুরুতেই বাজারে চলে এসেছে ‘অ্যাপল টিভি প্লাস’। এর মধ্য দিয়ে অ্যাপল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিনোদনের জগতে পা রাখল। আর এই দুই হেভিওয়েটের আগমনে একটু বেকায়দায় পড়েছে নেটফ্লিক্স। বিশ্লেষকেরা বলছেন, রিড হেস্টিংসের এই প্রতিষ্ঠান এখন সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হবে।

.
.

বিনোদনের ধারাবদল

বিনোদন ব্যবসার ধরন পুরোপুরি বদলে দিয়েছে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং। আগে মানুষের বাসাবাড়ির বিনোদন ছিল মূলত টেলিভিশনকেন্দ্রিক। ভিসিপি-ভিসিআরের যুগেও টিভি নিজের গুরুত্ব ধরে রেখেছিল। ভিসিডি-ডিভিডিও ছিল টিভিনির্ভর। এই ধারণা ভেঙে দিতে ২০০৭ সালে নেটফ্লিক্স প্রথম নিয়ে আসে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগে ভিডিও সাবস্ক্রিপশন। স্মার্টফোন মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ার পর ধরন বদলে সরাসরি অনলাইন ভিডিও স্ট্রিম শুরু করে নেটফ্লিক্স। প্রযুক্তিনির্ভর এই নতুন ব্যবসা এতটাই জনপ্রিয় ও ডলারপ্রসবিনী হয়েছে যে ডিজনি-অ্যাপল-আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এতে নজর দিতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে শুধু স্ট্রিমিং ব্যবসায় বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি নগদ অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এই ভিডিও স্ট্রিমিংকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ বছরে কনটেন্ট নির্মাণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানামাত্রিক অধিগ্রহণে খরচ হয়েছে কমপক্ষে ৬৫০ বিলিয়ন ডলার।

বাড়ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেমন ফেসবুকের একাধিপত্য রয়েছে, তেমনি এত দিন ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসাতেও অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়েছে নেটফ্লিক্স। বিশ্বজুড়ে ১৬০ মিলিয়নের বেশি গ্রাহক নেটফ্লিক্সের। কিন্তু এবার এতে ভাগ বসাতে এসে গেছে অনেকে। ডিজনি ও অ্যাপলের কথা তো আগেই হলো। আছে অ্যালফাবেটের ইউটিউব। অামাজনের ভিডিও স্ট্রিমিংসেবা হিসেবে আছে ‘আমাজন প্রাইম’। এ ছাড়া আরও ছোট কিছু প্রতিষ্ঠানও স্ট্রিমিং ব্যবসার অংশীদার হয়েছে। তবে ফেসবুক যেমন পুরো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের বাজার একাই দখল করে আছে, স্ট্রিমিং জগৎ ঠিক তেমনটা নয়। বাজার অংশীদারত্বের দিক থেকে স্ট্রিমিং ব্যবসায় কোনো প্রতিষ্ঠানই মোট বাজারের ২০ শতাংশের বেশি দখল করতে পারেনি। ফলে সবারই সুযোগ আছে অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার। সারা বিশ্বে স্ট্রিমিংসেবার গ্রাহক ৭০০ মিলিয়নের বেশি।

.
.

আসছে আরও...

এখানেই শেষ নয়। সামনেই আসছে আরও দুটি স্ট্রিমিংসেবা। ওয়ার্নার মিডিয়ার মালিক প্রতিষ্ঠান এটিঅ্যান্ডটি ঘোষণা দিয়েছে যে তারা ‘এইচবিও ম্যাক্স’ নিয়ে আসবে। এর মাধ্যমে অনলাইনে এইচবিও-র সব কনটেন্ট দেখতে পারবেন গ্রাহকেরা। মাসে ১৪ দশমিক ৯৯ ডলারের (১ হাজার ২৬৬ টাকা) বিনিময়ে যেমন দেখা যাবে গেম অব থ্রোনস, তেমনি পাওয়া যাবে নতুন নতুন সিরিজও।

আগামী বছর এনবিসি ইউনিভার্সাল আনবে ‘পিকক’। এই স্ট্রিমিং সাইট অন্যদের তুলনায় প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কেব্‌ল সংযোগ নিয়েছেন, এমন গ্রাহকেরা এই স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন। সাধারণত নেটফ্লিক্সসহ অন্যান্য স্ট্রিমিংসেবায় বিজ্ঞাপনের অত্যাচার সহ্য করতে হয় না। কিন্তু ওই অত্যাচার সহ্য করতে পারলে ‘পিকক’ নাকি ফ্রিতে মিলবে! অন্তত এখন পর্যন্ত এ আশ্বাসই দেওয়া হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ

ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছরের মাঝামাঝিতে স্ট্রিমিং যুদ্ধ মারাত্মক আকার নেবে। তবে ডিজনি-এইচবিও-অ্যাপলের চাপে নেটফ্লিক্সের চিড়েচ্যাপ্টা হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা কম। কারণ, স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট হিসেবে একমাত্র নেটফ্লিক্সই বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে। আবার নেটফ্লিক্সে কনটেন্টের সংখ্যাও ঢের বেশি। ৪৭ হাজার টিভি এপিসোড ও ৪ হাজার ছবি দিয়ে গ্রাহকদের ধরে রাখার চেষ্টা করছে নেটফ্লিক্স। এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছেই।

নক্ষত্রের পতন ঘটাতে তাই থানোসের জাদুকরি দস্তানাই ভরসা! অ্যাভেঞ্জাররা তাতে বাগড়া দিলে তো কথাই নেই। টেরাম টেরাম যুদ্ধ হবে।

তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, ব্লুমবার্গ, বিজনেস মিরর ও ওয়াশিংটন পোস্ট