বছর শেষ হচ্ছে উৎসবে-উচ্ছ্বাসে

বটতলা রঙ্গমেলায় দেখানো হয় ইরানের ক্রেজি বডি গ্রুপ দলের নাটক মিস্টিরিয়াস গিফট।  ছবি: সংগৃহীত
বটতলা রঙ্গমেলায় দেখানো হয় ইরানের ক্রেজি বডি গ্রুপ দলের নাটক মিস্টিরিয়াস গিফট। ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় নাট্যশালার সামনের জায়গাটা নাট্যপ্রাণ মানুষে মুখর। নাট্যশালা প্রাঙ্গণ সাজানো হরেক রকম বাতি দিয়ে। পাশেই করা হয়েছে বসার জায়গা। ছোট ছোট দলে নাট্যকর্মীরা আড্ডা দিচ্ছেন। এক কোনায় দেখা গেল নির্দেশক ও কবি শুভাশিস সিনহাকে। সঙ্গে আছেন অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা, সংস্কৃতিকর্মী আসলাম অরণ্যসহ কয়েকজন নাট্যকর্মী। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এমন চিত্রটাই দেখা গেছে।

আড্ডা দিচ্ছেন তাঁরা। তাতে উঠে এল বাংলা নাটকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক নাটকের মেলবন্ধনসহ নানা কিছু। বলে রাখা ভালো, ওই দিন ছিল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের আয়োজনে সাতটি নতুন নাটক নিয়ে নাট্যোৎসব ‘নতুনের উৎসব ২০১৯’–এর শেষ দিন।

বছরের শেষ মাস। মঞ্চপাড়া আলোড়িত উৎসবে–উচ্ছ্বাসে। নাগরিকের ওই উৎসব শেষ হতে না–হতেই গতকাল শুরু হয়েছে প্রাঙ্গণেমোরের দুই বাংলার নাট্যমেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ নাটমণ্ডল ও টিএসসি মিলনায়তনে করছে কেন্দ্রীয় বার্ষিক নাট্যৎসব। উদীচী প্রস্তুতি নিচ্ছে নাট্যোৎসবের। এ ছাড়া নভেম্বরের শেষ দিকে ধুমধামভাবে শেষ হলো বটতলার রঙ্গমেলা।

সদ্য শেষ হওয়া নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের উৎসবটি এ বছর নিয়ে এসেছে নানা বৈচিত্র্য। এই উৎসবের মাধ্যমে পান্থ শাহরিয়ারের রচনা ও নির্দেশনায় কালো জলের কাব্য নাটক দিয়ে আবার মঞ্চে এলেন নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর। গত বছর দলটির ৫০ বছর ও দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের ৪৫ বছর উদ্যাপনের অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয়েছে এই উৎসবের। এটি নতুন সাতটি নাটক দিয়ে সাজানো হয়েছে। নাটকগুলো মঞ্চে আনতে নাগরিক দিয়েছে প্রণোদনাও। একটি দলের প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি বেশ নজর কেড়েছে মঞ্চপাড়ায়। উদ্যোগটি নিয়ে প্রশংসা করলেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি শেষ হলো নাগরিকের আয়োজনে সাতটি নতুন নাটক নিয়ে উৎসব। এটা বেশ অর্থপূর্ণ উৎসব। কারণ, আমরা সব সময় বলেছি, এই যে ২০–৩০ হাজার টাকা করে প্রণোদনা দেয় নাট্যদলগুলোকে, এটা অর্থহীন। এতে কিছু হয় না। একটা নতুন প্রযোজনা করার জন্য যদি প্রণোদনা দেওয়া যায়, তাহলে এটা অর্থপূর্ণ হয়। সেই কাজটা নাগরিক সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় করেছে। এটা ভালো জিনিস হয়েছে বলে আমি মনে করি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ ১ ডিসেম্বর শুরু করেছে কেন্দ্রীয় বার্ষিক নাট্যোৎসব। চলবে ১০ দিন। এ বছর বিভাগটির রজতজয়ন্তীও হচ্ছে। বিভাগের চেয়ারম্যান আহমেদুল কবির জানান, নাটকগুলো শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার অংশ হলেও এগুলো ভালো মানের নাটক হয়ে ওঠে। শুধু তা–ই নয়, প্রতিবছর এই উৎসব দর্শকও তৈরি করছে। তিনি বলেন, ‘আমরা দেশি-বিদেশি নাটক করতে চাই। যাতে আমাদের শিকড়ের সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির একটা মেলবন্ধন ঘটে। এ কারণে আমাদের দেশের ধ্রুপদি নাটকের পাশাপাশি ইউরোপিয়ান, আমেরিকান নাটক মঞ্চস্থ করছি। আমি মনে করি, এই বিভাগ প্রতিবছর নতুন দর্শক সৃষ্টি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো হল আছে। সেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা আলোড়ন পড়ে যায়। এই দর্শকেরাই ভবিষ্যতে গ্রুপ থিয়েটারের নাট্যচর্চায় দর্শক হিসেবে তৈরি হচ্ছে।’

নভেম্বর মাসেও আইডিএলসি নাট্যোৎসব, নাট্যধারার তিন দিনব্যাপী নাট্যোৎসব ও তনুশ্রী পদক, থিয়েটারের মুনীর চৌধুরী ও মোহাম্মদ জাকারিয়া পদকসহ ছোট–বড় নাট্য আয়োজনে মুখর ছিল মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। সাধারণত শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতি ঘিরে উৎসব আয়োজিত হয়। সেই উৎসব এবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে গেল বটতলা। এই নাট্যোৎসব এবার ছিল বেশ আলোচনায়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে কেন্দ্র করে এমন উৎসব খুব কম দেখা গেছে। তা ছাড়া উৎসবটিতে শুধুই নাটক প্রদর্শনী হয়নি। ছিল পারফরম্যান্স, সেমিনার, গান, নাট্যজনদের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী। এসেছে ইরান, স্পেন, নেপাল ও ভারত থেকে নাটক। উৎসব চলাকালীন বটতলার সভাপতি শফি আহমেদ জানান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে মানুষের কাছে চেনাতে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। কারণ, নাটক মানুষকে সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়েও সচেতন করে। নাটক দেখতে এসে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও জানতে পারবে।

নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারও বললেন উৎসবটি নিয়ে। তিনি বলেন, ‘বছর শেষে এই উৎসবগুলো নাট্যাঙ্গনে খুবই প্রভাব ফেলবে। দু–তিনটা উৎসব খুব অর্থপূর্ণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বটতলা যেটা করল, তার মধ্যে অনেকগুলো নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে। এবার এই উৎসবগুলোতে দেখলাম, বাংলাদেশের বাইরে থেকে খুব নির্বাচিত ভালো দল এসেছে। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সব সময়ই বলি, আমরা যখন বিদেশি নাটক আনব, নাটক নির্বাচন করে ভালো নাটক আনব। দলটা মুখ্য নয়, নাটক মুখ্য। আমি মনে করি, প্রতিটি উৎসবে এই যে নতুন নতুন অনুষঙ্গ যোগ হওয়া শুরু হয়েছে; নতুন যাঁরা উৎসব করবেন, তাঁরা যেন ভাবেন, নতুন কী করা যায়।’

গতকাল শুরু হয়েছে প্রাঙ্গণেমোরের দুই বাংলার নাট্যমেলা। দেশের পাশাপাশি ভারতের বেশ কিছু নাটক থাকছে এই আয়োজনে। এটি চলবে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। শোনা গেছে, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর নাটক বিভাগও চলতি মাসেই নাট্যোৎসবের আয়োজন করছে।