যেভাবে সৃষ্টি 'জয় বাংলা বাংলার জয়' গানটি

আনোয়ার পারভেজ ও গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ছবি: সংগৃহীত
আনোয়ার পারভেজ ও গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ছবি: সংগৃহীত

‘জয় বাংলা বাংলার জয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়
কোটি প্রাণ এক সাথে জেগেছে অন্ধ রাতে
নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়...’

এই গানের মধ্য দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে হানাদার বধে এগিয়ে যায় বাংলার ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ সব শ্রেণির জনতা। গানটি বাংলার মুক্তিপিপাসু মানুষের চেতনায় আগুন ধরায়। যার কারণে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটিকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রণসংগীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে এই গানকে আরাধ্য করেই মুক্তির পথে এগিয়ে যায় সমগ্র বাঙালি। এই গান স্বাধীন বাংলা বেতারের সূচনা সংগীত; জাতীয় স্লোগানও বটে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে কালজয়ী ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি সারা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে, সেই গানের সুরস্রষ্টা আনোয়ার পারভেজ। গানটি লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। আনোয়ার পারভেজ ২০০৬ সালের ১৭ জুন প্রয়াত হয়েছেন। বেঁচে আছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।

জীবনকালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আনোয়ার পারভেজ শুনিয়েছিলেন ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটির সৃষ্টির কথা। আজ বিজয় দিবসে তাঁর স্মৃতিচারণায় শোনা যাক কালজয়ী গানটির সৃষ্টির কথা।

স্মৃতিচারণায় আনোয়ার পারভেজ বলেন, ‘৭০ সালের কথা। ফকরুল ভাইয়ের ছবি “জয় বাংলা”–তে সংগীত পরিচালনা করছি। একে তো ছয় দফা নিয়ে ছবি, তাতে আবার গাজী (গাজী মাজহারুল ইসলাম) ঠিক করল ছবির জন্য অসাধারণ কিছু গান লিখবে। গান তো লিখল, কিন্তু এমন অবস্থা যে সুর করার জন্য যে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের সঙ্গে কোথাও বসব, সেই জায়গাটাই পাই না। ঠিক করলাম রাস্তায় দাঁড়িয়েই সুর করে ফেলব। এখন যেটা সংসদ ভবন, তখন আমরা চিনতাম “সেকেন্ড ক্যাপিটাল” বলে। সেই সেকেন্ড ক্যাপিটালের উল্টো দিকে গলির ভেতর রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাজীকে বললাম, দোস্ত গানটা বের কর। ও বলে, আরেকবার একটু কলম চালাতে পারলে হতো। আমি দেখলাম, সে সময় কই। তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে গানটা নিয়ে দেখি, কী অসাধারণ কথার এক গান। ধমক দিয়ে বললাম, এর আর বদলাবি কী? আয়, সুর করে ফেলি। ২০ মিনিট! মাত্র ২০ মিনিটে আমরা তৈরি করে ফেললাম। তখন সবার মুখে মুখে ফেরা সেই “জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানের কম্পোজিশন।’

স্মৃতি দরজায় কড়া নেড়ে আনোয়ার পারভেজ আরও বলেন, ‘সেদিন গান তো তৈরি হলো, কিন্তু ভয় ওই রেকর্ডিং নিয়ে। জব্বার ভাইদের বলা হলো। কিন্তু চারদিকে তখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন গান রেকর্ড করা মারাত্মক ঝুঁকির কাজ। তারপরও জায়গা ঠিক হলো ইন্দিরা রোডের ঢাকা রেকর্ডিং স্টুডিও। গভীর রাতে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শুরু হলো রেকর্ডিং। বাইরে কী হচ্ছে, আমরা ভেতর থেকে কিছুই টের পাচ্ছি না। রেকর্ডিং শেষ হতেই বাইরে এসে দেখি, ওরে বাবা রে বাবা! সেই নিশুতি অন্ধকারে কোত্থেকে লোকজন খবর পেয়েছে এখানে “জয় বাংলা” ছবির গান রেকর্ডিং হচ্ছে। আর যায় কোথা! কয়েক শ লোক মিলে শুরু করেছে স্লোগান “জয় বাংলা”। আমরা দেখলাম এ তো মস্ত বিপদ। ওদিকে পাশে সেনাদের ক্যাম্প। এখন ধরা পড়লে রিলটিল সব নিয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা পালালাম পেছনের দরজা দিয়ে। একেবারে রাজাবাজার হয়ে যার যার বাড়ি।’

আনোয়ার পারভেজ বলেছিলেন, ‘“জয় বাংলা” গানটার কথা মনে হলে আরেকটা কথা খুব মনে পড়ে, তা হলো এই ছবির আবহসংগীত ধারণ। একের পর এক এসব ঘটনা ঘটার পর আবহসংগীত রেকর্ডিংয়ের জন্য বাংলাদেশে কোনো স্টুডিওই আর নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। ফকরুল ভাই ঠিক করলেন একেবারে বাঘের ঘরে গিয়েই কাজ সারবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে। সমস্যা হলো, ছবির আসল নামে কাজ করতে গেলে অনুমতি তো পাওয়াই যাবে না, বরং ধরে জেলে পুরবে। অতএব নাম বদলে করা হলো “সংঘাত”। ওই তথাকথিত “সংঘাত” ছবির আবহসংগীত করতে আমরা চলে গেলাম লাহোরে। তাও যদি এক স্টুডিওতে কাজ সারা যেত! পুরো রিল দেখলে মূল ব্যাপার ফাঁস হয়ে যাবে এই ভয়ে অন্তত গোটা পাঁচেক স্টুডিওতে ভাগ ভাগ করে রেকর্ডিং করা হলো। সৃষ্টি হলো “জয় বাংলা”।’

এক সাক্ষাৎকারে গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘আমার কথার আনোয়ার পারভেজ যে সুরের অলংকার পরিয়ে দিয়েছিলেন, তা মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। লেখক–সাংবাদিকের কাছে তাঁর কলম, কণ্ঠশিল্পীর কাছে তাঁর কণ্ঠ আর গীতিকারের কাছে তাঁর গান ছিল তখন অস্ত্র। আমি মনে করি, “জয় বাংলা বাংলার জয়” গানটি মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টা মাস মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ গান একটি যুদ্ধ, এ গান একটি স্বপ্ন, এ গান একটি বাস্তবতা। এ গানেই দেশের সব চাওয়ার কথা, মুক্তির স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে।’