দুখু মিয়ার ও লেটোর দলের গল্প

‘আকাসে ফুইটেছে ফুল-লেটো কাহন’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘আকাসে ফুইটেছে ফুল-লেটো কাহন’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল গতকাল সোমবারের পৌষ-সকালটি। পঞ্জিকার হিসাবে কাল ছিল ৮ পৌষ। সকাল পেরিয়েই ঝলমলে সূর্যের আলো, সঙ্গে হিমেল হালকা বাতাস। সন্ধ্যায় জমেছিল শীত। রাজধানীর নাট্যাঙ্গন কাল যেন শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই জমে উঠেছিল। জাতীয় নাট্যশালায় বিপুল মানুষের সমাগম দেখা গেছে। মূল মিলনায়তনে গতকাল সন্ধ্যায় মঞ্চায়িত হয়েছে নাগরিক নাট্যাঙ্গন প্রযোজিত ও হৃদি হক নির্দেশিত নাটক ‘আকাসে ফুইটেছে ফুল-লেটো কাহন’।

এটি নাগরিক নাট্যাঙ্গনের নতুন নাটক। নাটকটি লিখেছেন রতন সিদ্দিকী। এটি দলের ২৬তম প্রযোজনা। নির্দেশনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন হৃদি হক। ৫০ জনের একটি দল এ নাটকে কাজ করেছেন। নাটকটিতে মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন সাজু খাদেম।

ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে নাটকটি। একটি লেটোর দলকে কেন্দ্র করে গল্প এগিয়ে যায়। যে দল আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে রাখে চুরুলিয়া-আসানসোল। জনপ্রীতি আর মনোতৃপ্তিতে তাদের সময় কেটে যায় । এরই মধ্যে একদিন ঘোষিত হয় বঙ্গভঙ্গ । বিভক্ত হয় বাংলা। জন্ম হয় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে বিষিত বিরোধে জড়িয়ে যায় বাঙালি হিন্দু-মুসলমান। বিষাক্ত হয়ে ওঠে কলকাতা, ঢাকা, বর্ধমান। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় লালিত হাজার বছরের বাঙালি বিস্মৃত হয় তার ঐতিহ্য থেকে ।

‘আকাসে ফুইটেছে ফুল-লেটো কাহন’ নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ২৬তম প্রযোজনা। ছবি: সংগৃহীত
‘আকাসে ফুইটেছে ফুল-লেটো কাহন’ নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ২৬তম প্রযোজনা। ছবি: সংগৃহীত

এই গ্লানিময় বিষাক্ত বাতাস এসে লাগে দূরের লোকালয়েও। ভারাক্রান্ত করে চুরুলিয়া-আসানসোলের জনপদকে। মলিন করে লোকনাট্য লেটোকে। তারা আক্রান্ত হয় ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা। লেটোর দলে কেউ কেউ যোগ দেয় ওদের সঙ্গে। ভেঙে যায় দল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আনন্দ-আয়োজন লেটো বন্ধ হয়ে যায় । সদস্যদের গ্রাস করে হতাশা, দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তা। এ সময় হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃঘাতী বিরোধ নিরসনে এবং বঙ্গভঙ্গ রদের দাবিতে সোচ্চার হন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমৃতলাল বসু প্রমুখ। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান গেয়ে, রাখি বেঁধে সম্প্রীতির আহ্বান জানালেন। বাংলা বিভক্তির বিরোধিতা করলেন ।

নির্দেশনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন হৃদি হক। ছবি: সংগৃহীত
নির্দেশনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন হৃদি হক। ছবি: সংগৃহীত

১৯১১ সালে লক্ষজনের নিরন্তর সংগ্রাম ও প্রচেষ্টায় বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়। বাঙালি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু তত দিনে গায়কের অভাবে লেটোর দল বিলুপ্ত হতে বসেছে। এমনি ক্রান্তিকালে ভাঙা লেটোর দলে যুক্ত হয় চুরুলিয়ার হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে দুখু মিয়া। তার গায়কি দক্ষতায় আবার জেগে ওঠে লেটোর দল। মেতে ওঠে চুরুলিয়া-আসানশোলের প্রান্তিক মানুষ ।

নাটকটিতে আলোক পরিকল্পনা করেছেন ইসরাত নিশাত। পোশাক পরিকল্পনায় করেছেন আইরিন পারভিন। নৃত্যভঙ্গি পরিকল্পনা করেছেন রায়হানুল আলম। নাটকটির আবহ সংগীতের দায়িত্বে ছিলেন বর্ণ বাদল। আলোক প্রক্ষেপণ করেছেন পবন আহমেদ।

দুখু মিয়ার গায়কি দক্ষতায় আবার জেগে ওঠে লেটোর দল। ছবি: সংগৃহীত
দুখু মিয়ার গায়কি দক্ষতায় আবার জেগে ওঠে লেটোর দল। ছবি: সংগৃহীত

বর্ধমানের আঞ্চলিক ভাষায় পরিবেশিত হয় নাটকটি। যেখানে লেটো দলকে কেন্দ্র করে তৎকালীন ভারতীয় সমাজজীবন-রাজনীতি দারুণভাবে তুলে ধরেছেন নির্দেশক। যেখানে ফুটে ফুটে উঠেছে লেটোর নানা অনুষঙ্গ, প্রতিকূলতা, তৎকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। নৃত্য-গীত-হাস্য-অভিনয়ে কংগ্রেস, বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ গঠন, ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বুননের ইতিহাসের দেখা মেলে।

ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে নাটকটি। ছবি: সংগৃহীত
ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে নাটকটি। ছবি: সংগৃহীত

হৃদি হক ছাড়াও নাটকটিতে অভিনয় করেছেন হাবিব বাহার, জুয়েল জহুর, সুমন আহমেদ, আসিব চৌধুরী, সুতপা বড়ুয়া প্রমুখ। সম্প্রতি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নতুনের উৎসবে ‘আকাসে ফুইটেছে ফুল-লেটো কাহন’ নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়।