ফিরে আসছে যাত্রার সুদিন

>বাংলা লোকসংস্কৃতির প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিনোদন মাধ্যমগুলোর মধ্যে ‘যাত্রাপালা’ অন্যতম। অন্যান্য বিনোদন মাধ্যমের প্রভাবে যাত্রা আজ তার কৌলীন্য হারিয়েছে, ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে এক বিলুপ্তপ্রায় শিল্পে পরিণত হয়েছে। গত বছরে নানা কার্যক্রমে বিলুপ্তপ্রায় যাত্রাকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বছরের শুরুতে যাত্রাপালার ফিরে আসার সুখবর দিচ্ছেন মাসুম আলী।
এসেছে নতুন যাত্রাপালা, চলছে উৎসব
এসেছে নতুন যাত্রাপালা, চলছে উৎসব

কী দিন ছিল যাত্রার! পৌরাণিক, ঐতিহাসিক থেকে সামাজিক পালার কদর এই শীতের মৌসুমে দারুণ বেড়ে যেত। শীতের সেই রাতগুলো জেগে থাকত ক্ল্যারিওনেট, কর্নেট, ফ্লুটের সমবেত কনসার্টে। রাতভর পালা হতো, দূর–দূরান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় জমাত আসরে তাদের প্রিয় শিল্পীদের অভিনয় দেখার জন্য। 

তারপর একসময় মনে হয়েছিল যাত্রাশিল্প বুঝি নির্বাসনে গেছে। গ্রামে বা শহরে যাত্রাপালা হয় না, ভিড় জমে না। এই সময়ে যাত্রা হিসেবে বাজারে যা প্রচলিত ছিল তা শুধুই সস্তা মনোরঞ্জনের প্যাকেজমাত্র, যাত্রার মূল উপাদান তাতে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না বলে প্রবীণ শিল্পীরা নানা সময়ে মন্তব্য করেছেন। তবে এ বিষয়ে আপাতত আর হতাশ হওয়ার কারণ নেই। 

যাত্রায় দিন বুঝি ফিরছে আবার। জাতীয় পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা দলগুলোও নতুন পালার উদ্যোগ নিয়েছে। এই শীতে দেশে নানা অঞ্চলে ১৮টি যাত্রা উৎসব চলছে।

৬৪ জেলায় ৬৪টি যাত্রাপালা
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যাত্রাশিল্পের সুদিন ফিরিয়ে আনতে নানা ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ‘যাত্রাশিল্পের নবযাত্রা’ স্লোগান ধারণ করে যাত্রা-নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং কয়েক বছর ধরে শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক যাত্রাদল নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে ১০৬টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। যাত্রাদল নিবন্ধনের জন্য গত বছরের ১২ ও ১৩ নভেম্বর দশম যাত্রানুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। পরে ২৮ ও ২৯ নভেম্বর দুই দিন জাতীয় নাট্যশালার স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ১১তম যাত্রানুষ্ঠান। 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এরই মধ্যে ঈসা খাঁ শিরোনামে একটি প্রাতর্যাত্রা নির্মাণ এবং মুনীর চৌধুরী রচিত রক্তাক্ত প্রান্তর নাটককে যাত্রাপালায় রূপান্তর করে মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেছে। বর্তমানে আরও পাঁচটি যাত্রাপালা মঞ্চে আনার কাজ চলছে।

এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি দেশীয় যাত্রাপালা নির্মিত হচ্ছে। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে ৬৪টি দেশীয় যাত্রাপালা নির্বাচন করে জেলায় জেলায় পাঠানো হয়েছে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে পালাগুলোর নির্মাণ ও মঞ্চায়ন কার্যক্রম শেষ হতে যাচ্ছে। যাত্রাশিল্প নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির এসব কার্যক্রম যাত্রাশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা পালন করবে বলে আশা প্রকাশ করছেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী। তিনি জানান, যাত্রাশিল্পের উন্নয়ন, বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য ৬৪টি জেলায় ৬৪টি দেশীয় যাত্রাপালা নির্মাণ ও প্রদর্শনীর আয়োজন এবং প্রতিটি জেলায় যাত্রাপালা পরিবেশনের জন্য জেলা শিল্পকলা একাডেমিকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিবন্ধিত যাত্রাদল দেশ অপেরা, লোকনাট্য গোষ্ঠী ও জয়যাত্রাকে নতুন দেশীয় যাত্রাপালা নির্মাণ ও প্রদর্শনীর জন্য এক লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলায় যাত্রা উৎসবে সহযোগিতা দেওয়া হবে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ইতিমধ্যে ১০টি পর্যায়ে ১১১টি যাত্রাদলকে নিবন্ধনপত্র প্রদান করেছে এবং ১৫টি যাত্রাদলের নিবন্ধন বিভিন্ন অভিযোগে বাতিল করেছে। আরও ৬টি দলের নিবন্ধনপ্রক্রিয়া চলছে। আগের বছরগুলোয় পেশাদার দলের সংখ্যা কম ছিল। বর্তমানে সংগঠিত পেশাদার দলের সংখ্যা ২২। বাড়ছে।

নরসিংদীর সবিতা নাট্য সংস্থার রূপবান যাত্রার দৃশ্য
নরসিংদীর সবিতা নাট্য সংস্থার রূপবান যাত্রার দৃশ্য

‘যাত্রাপালায় বিন্দুমাত্র অশ্লীলতা থাকে না’
যাত্রাশিল্প উন্নয়নের জন্য মৌসুম ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে যাত্রা প্যান্ডেল নির্মাণ এবং দেশীয় পালাকারদের সংকট নিরসনের জন্য নতুন পালা তৈরির লক্ষ্যে পালাকারদের সহযোগিতা করবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এমনটাই জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক। রয়েছে প্রতিবছর জাতীয়ভাবে যাত্রা উৎসব প্রতিযোগিতার আয়োজন, নিয়মিতভাবে যাত্রাবিষয়ক বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা। 

যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে এই আয়োজনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘এর ফলে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচবে আমাদের এই যাত্রাশিল্প।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখনো যাত্রাপালা পরিবেশনে স্থানীয় প্রশাসন বাধা দেয় কিংবা অনুমতি দিতে গড়িমসি করে। অথচ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিবন্ধনকৃত দলগুলো এমন পরিস্থিতিতে পড়ার কথা নয়।’ যাত্রাপালায় বিন্দুমাত্র অশ্লীলতা থাকে না বলেও দৃঢ়ভাবে বললেন মিলন কান্তি দে। তিনি বলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, যাত্রাপালায় কোনো প্রকার অশ্লীলতা হয় না। তবে যাত্রা শুরুর আগে কোনো কোনো এলাকার আয়োজক কমিটি যাত্রামঞ্চে অশালীন নৃত্যগীতের আয়োজন করে থাকে। এই নৃত্যের জন্য বাধ্য করেন স্থানীয় গডফাদার ও প্রভাবশালীরা। অতীতে এমন অজুহাতে যাত্রাশিল্প বন্ধের নানা অপচেষ্টা করা হয়েছে। এ যেন মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলারই নামান্তর।’

 নতুন নতুন যাত্রা আসছে নগরে, গ্রামে
গত বছর ডিসেম্বরে সর্বশেষ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে পরিবেশিত হয় দেশ অপেরার যাত্রাপালা বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা। যাত্রাপালাটির নির্দেশনা দিয়েছেন মিলন কান্তি দে, পালাটি লিখেছেন আমিনুর রহমান। সেদিন মিলনায়তন–ভর্তি দর্শক পালাটি উপভোগ করেছেন। 

মূলত যাত্রাদল না হয়েও সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে নতুন যাত্রাপালা এনে ঢাকার মঞ্চে সাড়া ফেলেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর যাত্রাপালা বিয়াল্লিশের বিপ্লব। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে পালা লিখেছেন প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, নির্দেশনা দিয়েছেন ভিক্টর দানিয়েল। উদীচীর আজকের প্রেক্ষাপটে যাত্রাপালা মঞ্চে আনা প্রসঙ্গে উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার বলেন, উদীচী মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ বিনির্মাণের লড়াইয়ে পথ চলছে অবিরাম। সে চলায় যাত্রা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি মনে করেন, যদি দেশের স্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে তরুণেরা সমাজের ভেতরে বিরাজমান স্বার্থপর সাম্রাজ্যবাদী দেশীয় দালাল, মজুতদার, মুনাফালোভী লুটেরাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন, তবেই সার্থক হবে বিয়াল্লিশের বিপ্লব, সার্থক হবে উদীচীর এ প্রয়াস। 

গত বছর পুরোনো পালার পাশাপাশি নতুন নতুন পালার উদ্বোধন হয়েছে। ছিল মামুনুর রশীদের দ্বীপের নাম আন্ধার মানিক, মিলন কান্তি দের এক যে ছিলেন মহারানি ও বঙ্গবন্ধুর ডাকে, আমিনুর রহমানের জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বিঘা জমি অবলম্বনে শ্যামল দত্তের পালা, প্রাচীন যাত্রাপালা সোহরাব-রুস্তমের আধুনিক সংস্করণ; এ ছাড়া কবি আল মাহমুদের রচনা নিয়ে কত দূর এগোলো মানুষ নামে একটি নতুন পালা মঞ্চায়ন করেছে স্বরূপকথা যাত্রা সংগঠন।