বছরের শুরুতে চলচ্চিত্রের সুখবর

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ছবির পোস্টার
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ছবির পোস্টার

২০১৯ সাল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য কতটা ভালো ছিল আর কতটা খারাপ; তাই নিয়ে চলছে তর্ক ও বিতর্ক। সে বিতর্কে ‘ভালো যায়নি’র পাল্লাই ভারী। তবু আশা থেকে যায়। সে আশায় দেশের চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভবিষ্যতের সোনালি দিনের দিকে তাকিয়ে কাজ করে যান। পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যান। চোখ ভর্তি স্বপ্ন নিয়ে সেই দলে যোগ দেন নতুন নতুন কর্মী। একটু একটু করে তাঁরাই পরিবর্তন ঘটানোর দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজেদের কাঁধে। তেমন কিছু ছোট ছোট আশা আর সম্ভাবনার কথা নিয়ে এই আয়োজন।

বাজিমাত করেছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হোম ভিডিও প্ল্যাটফর্ম ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের চলচ্চিত্র সাময়িকী ‘দ্য কারেন্ট’-এর ‘দশের দশকের গুপ্তধন’-এর তালিকায় শীর্ষ দশে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। ৩০ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘“মেড ইন বাংলাদেশ” ছবিতে শ্রমিকদের ওপর বৈশ্বিক শোষণ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও বাণিজ্যিক লোভের মতো এই দশকের কিছু গুরুতর সমস্যা প্রতিফলিত হয়েছে। তা ছাড়া উঠে এসেছে এই দশকে ঘটে যাওয়া নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীশক্তির জাগরণের মতো সর্বজনীন বিষয়ও।’

গত বছর ৪ ডিসেম্বর ফ্রান্সে মুক্তির পর ৫৩টি থেকে বেড়ে ৬৪টি প্রেক্ষাগৃহে চলেছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। ডেনমার্ক আর পর্তুগালেও মুক্তি দেওয়া হয়েছে এই ছবি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পোল্যান্ড আর জাপানেও মুক্তি পাবে এই ছবি।

প্রথম আলোকে এই নির্মাতা জানিয়েছেন, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’র সিনেমার সিকুয়েল আসবে। সেখানে দেশের সীমানার বাইরে থেকে যেসব নারী শ্রমিকেরা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন, বলা হবে তাঁদের গল্প। বিশেষ করে লেবানন, জর্ডান ও মরিশাসেই গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করেন প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশি নারী। প্রতিবছর আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার নারী পাড়ি জমাচ্ছেন সেসব দেশে। সেই মানুষগুলোর সংগ্রামের গল্প উঠে আসবে পরবর্তী ছবিতে। 

এই নির্মাতার মতে, বছরটা খারাপ যায়নি। নিজের কাজ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য অর্জনের খাতায় তিনি রেখেছেন ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ আর ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’ ছবি দুটিকে। আলাদা করে বলেছেন আরিফুর রহমান ও বিজন ইমতিয়াজ প্রযোজিত বাংলাদেশ-আফগানিস্তান যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রোকাইয়া’র নাম।

সাজেদুল ইসলাম। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
সাজেদুল ইসলাম। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

সাজিদ বুসানে, আদনান ইউরোপে
২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান এশিয়ান ফিল্ম স্কুলে পড়ার জন্য আরিফুর রহমানের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিসিটিআইয়ের সাবেক ছাত্র, নির্মাতা ও গবেষক সাজেদুল ইসলাম। বিশ্বের ২৫টি দেশের ২০৯ জন আবেদনকারীর মধ্যে দুই দফায় সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ১৬টি দেশের সেরা ২০-এ নির্বাচিত হন তিনি। আগামী ১ মার্চ মূলত প্রযোজনার ওপর শুরু হবে ছয় মাসের ক্লাস। তারপর এই ফেলোশিপের অংশ হিসেবে প্রত্যেককেই নিজ নিজ দেশে ফিরে সে দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ওপর গবেষণা করতে হবে। সেই গবেষণার ফলাফল নিয়ে বিএএফএস একটি প্রকাশনা বের করবে, যাতে করে আন্তর্জাতিক প্রযোজক ও নির্মাতাদের জন্য এশিয়ার চলচ্চিত্রের বাজারকে বুঝতে সহজ হয়। তা ছাড়া প্রত্যেকের একটি করে ফিচার ফিল্মের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করবে এই ফিল্ম স্কুল।
অন্যদিকে ২০২০ সালের ইউরোপিয়ান অডিও-ভিজ্যুয়াল উদ্যোক্তা আয়োজিত প্রযোজকদের কর্মশালার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের আদনান ইমতিয়াজ আহমেদ। ৫৭টি দেশের ২৪৯ জন আবেদনকারীর মধ্য থেকে ৩৮টি দেশের ৫৪ জন প্রযোজককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এ কর্মশালায়। লুক্সেমবার্গ, পশ্চিম আয়ারল্যান্ড আর ক্রোয়েশিয়ায় তিন ধাপে এক সপ্তাহ করে মোট তিন সপ্তাহ চলবে এই কর্মশালা। আমন্ত্রিতদের মধ্যে যে তিনজনের খরচ ফরাসি সিএনসি ফান্ড বহন করবে, তাঁদের মধ্যে একজন আদনান। তিনি সেখানে ‘পিঙ্ক ব্লসম’ প্রজেক্ট নিয়ে যাবেন।

আদনান ইমতিয়াজ আহমেদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আদনান ইমতিয়াজ আহমেদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

২০২০ সালে মুক্তি পাবে যেসব ছবি
অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘রিকশা গার্ল’, গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘পাপ পুণ্য’, চয়নিকা চৌধুরীর ‘বিশ্বসুন্দরী’, মাহমুদ দিদারের ‘বিউটি সার্কাস’, রুবাইয়াত হোসেনের ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, কাজী হায়াতের ‘বীর’, সৈকত নাসিরের ‘ক্যাসিনো’, মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’, রবিন খানের ‘মন দেব মন নেব’, রায়হান রাফির দুটি ছবি ‘পরান’ ও ‘ইত্তেফাক’, এম এ রাহিমের ‘শান’, ফয়সাল আহমেদ ও সানী সানোয়ারের ‘মিশন এক্সটিম’, নুরুল আলম আতিকের ‘পেয়ারার সুবাস’, নাদের চৌধুরীর ‘জ্বিন’, শামীম আহমেদের দুটি ছবি ‘শাহেনশাহ’ ও ‘বিক্ষোভ’, দীপংকর দীপনের ‘অপারেশন সুন্দরবন’, হাবিবুর রহমানের ‘অলাতচক্র’, শাহিন সুমনের ‘একটু প্রেম দরকার’, অঞ্জন আইচের ‘আগামীকাল’ ও সাইফ চন্দনের ‘ওস্তাদ’, নার্গিস আক্তারের ‘যৈবতী কন্যার মন’, রেজওয়ান শাহরিয়ারের ‘নোনাজলের কাব্য’, কামার আহমাদ সাইমনের ‘নীল মুকুট’ ছবিগুলো মুক্তি পাওয়ার কথা আছে। আরও যেসব ছবি মুক্তির সম্ভাবনা আছে, তার মধ্যে রয়েছে ‘অন্যদিন’ ও ‘শিকলবাহা’ নামে কামার আহমাদ সাইমনের দুটি ছবি।

অমিতাভ রেজা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
অমিতাভ রেজা চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

ভবিষ্যতে চলচ্চিত্রে থাকবে যাঁদের ভূমিকা
২০১৯ বছরটা কেমন ছিল? নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরীর বক্তব্যের অনেকটা অংশজুড়ে ‘হয় নাই’ থাকলেও তিনি আশাবাদী। তাঁর এই আশাবাদ শিক্ষিত তরুণ নির্মাতাদের নিয়ে। তিনি বলেন, ‘শুধু ২০১৯ সালে কেন, গত দশ বছরে আমাদের সিনেমা তেমন কোনো অগ্রসর হয়নি। সিনেমাকে যদি আমরা আর্ট বা অতঁর এক্সপ্রেশনের অভিপ্রায়ে বিচার করি, তাহলে তো ২০১৯ সালে আমাদের তেমন কোনো কাজ দেখতে পাই না, যা নিয়ে আমাদের সিনেমা ইতিহাসে নাম লেখাবে। আর সিনেমাকে যদি ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট হিসেবে বিচার করি, তাহলেও তেমন কোনো অগ্রসর আমি দেখতে পাই না।’
আশা আর সম্ভাবনার কথাও বলেছেন তিনি, ‘তবে ভার্টিক্যাল ইন্টেগ্রেশনের বিচারে প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রসর হয়েছে; যা ভবিষ্যৎ সিনেমার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। তা হলো নতুন সিনেপ্লেক্স নির্মাণ। বিপণন ক্ষেত্রে সিনেমা ম্যাচিউর হতে শিখছে। “দেবী” বা “ন ডরাই” ছবির ক্ষেত্রে আমরা তা দেখেছি। সিনেমার ভোক্তা তার আধেয়ের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। হল থেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গেছে সিনেমা। সেখানে আমাদের ভালো কাজের সুযোগ রয়েছে। গত এক বছরে সিনেমার অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বের হয়েছে, যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র নিয়ে প্রাথমিকভাবে শিক্ষিত—যা ভবিষ্যতে আমাদের সিনেমায় ভূমিকা রাখবে।’

হইচই বাংলাদেশের জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘মানিহানি’র পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
হইচই বাংলাদেশের জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘মানিহানি’র পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির ইতিবাচক ভূমিকার সম্ভাবনা
দীর্ঘ সাত বছর পর গত বছর ২৭ জুলাই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দুজন সহযোগী সদস্যসহ ২১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে। পিছিয়ে পড়া ঢালিউড নিয়ে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন চলচ্চিত্রের মানুষ। ছবির নির্মাণ বাড়াতে ইতিমধ্যে ছবি বানালেই সংগঠনটির সদস্যপদ দেওয়ার সুবিধা চালু করা হয়েছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব “নতুন মুখের সন্ধানে” প্রতিযোগিতার কার্যক্রম শুরু হবে। এ প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের নিয়ে আমরা কমিটির ১০ জন সদস্য ১০টি ছবির ঘোষণা দেব। আশা করছি ২০২০ সালের মধ্যেই সেটা সম্ভব হবে।’

মান ভালো হয়েছে প্রামাণ্যচিত্রের
প্রামাণ্যচিত্র যে চলচ্চিত্র, সেটি দেরিতে হলেও দেশের মানুষ একটু একটু করে বুঝতে পারছে। বৈচিত্র্যময় বিকল্প প্রদর্শনীর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে চলচ্চিত্রবিষয়ক ক্লাব আর সংগঠনের সংখ্যা। নির্মাতা মানজারে হাসীন মুরাদ বলেন, ‘প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে নির্মাতাদের আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু দর্শক এই ধারাকে পুরোপুরি গ্রহণ করেনি। সেটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ দিন শেষে দর্শকদের রায়ই শেষ কথা। দর্শক গ্রহণ না করলে নির্মাতাদের আনুকূল্য পেতে খুবই অসুবিধা হবে। তবে কাহিনিচিত্রের তুলনায় প্রামাণ্যচিত্রের মান ভালো হয়েছে।’

অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নিয়ে নতুন ভাবনা
হইচই বাংলাদেশ, বঙ্গ, বায়োস্কোপ, জি ফাইভ, রবিসহ বাংলাদেশে কয়েকটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম যাত্রা শুরু করেছে। নতুন বছরে তারা নতুনভাবে নতুন নতুন কনটেন্ট নিয়ে হাজির হবে বলে জানিয়েছে। আসবে নতুন ওয়েব সিরিজ, নাটক আর সিনেমা।