নগরে সারা দেশের শিল্পের সুষমা

বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২০–এর উদ্বোধনী আয়োজন। ছবি: িশল্পকলা একাডেমি
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২০–এর উদ্বোধনী আয়োজন। ছবি: িশল্পকলা একাডেমি

এবার শীতের পিছু পিছু শহরে এসে পড়ল জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসব। ঠিক এক ফালি রোদ যেমন প্রাণ জুড়ায়, তেমনি সংস্কৃতি অনুরাগীদের মনের খোরাক জোগাচ্ছে এ আয়োজন। ঢাকায় বসে মিলছে ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা, পালা, যাত্রা, অ্যাক্রোবেটিক, পুতুলনাচ আরও কত কী! কেমন হচ্ছে এ 

উৎসব, কী কী থাকছে এ আয়োজনে—বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাসুম আলী। 

গুনাই বিবির পালার একটি দৃশ্য
গুনাই বিবির পালার একটি দৃশ্য

সারা দেশের শিল্পের পরিবেশনা এক প্রাঙ্গণে
শেষ কবে গায়ে চাদর জড়িয়ে পৌষের রাতে খোলা আকাশের নিচে যাত্রা দেখেছেন? পালাগান শুনেছেন শেষ কবে? কমলালেবু হাতে নিয়ে গা শিরশির করা হিমেল হাওয়ায় বিকেলটা কাটিয়েছেন বলীখেলা, লাঠিখেলা দেখে? শহরে দেখা যায় না এমন অনেক দৃশ্যের দেখা মিলছে রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির খোলা চত্বরে। বছরের শুরু থেকে এখানে চলছে ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব’। দেশের ৬৪টি জেলা, ৬৪টি উপজেলা এবং জাতীয় পর্যায়ের পাঁচ হাজারের বেশি শিল্পী ও শতাধিক সংগঠনের অংশগ্রহণে চলছে এই উৎসব। আয়োজকদের দাবি, ২১ দিনের শিল্প–উৎসব স্মরণকালের বৃহৎ আয়োজন। 

 ‘স্মরণকালের বৃহৎ’ কি না, তা সময়ই প্রমাণ করবে। তবে আয়োজনের বিচিত্রতা আর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ দেখে বলা যায়, সাড়া ফেলেছে এ উৎসব। অন্তত বিগত ছয় দিনের আয়োজন দেখে সেটা মনে হয়েছে। 

পদ্মার নাচন ও গুনাই বিবির পালায় মুগ্ধ রাত
‘দারুণ গতিময়তা! সময়ের ছন্দ-তাল-ভঙ্গি!’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ মন্তব্য করেন শিল্পী নাসরিন নামের এক দর্শক। আসলাম অরণ্য নামের একজন দর্শক (আলোকচিত্রী) সোমবার রাতে তোলা পদ্মার নাচনের গতিময় নৃত্যের ছবি শেয়ার করেছেন। উৎসবের চতুর্থ রাতের পরিবেশনা দারুণ সাড়া ফেলেছে দর্শকের মধ্যে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সব আসন ভরে যায়, দাঁড়িয়েও অনেক দর্শক দেখেছেন এ আয়োজন। এদিন পদ্মার নাচন রীতিতে কুষ্টিয়ার রেজাউল সলক এবং নছিমন নাট্যগোষ্ঠীর শিল্পীরা পরিবেশন করেন চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য পালা ও বেহুলার বিয়ে। 

 আসরের শুরুতে দেখা গেল বাদ্যযন্ত্রী ও অন্যান্য কুশীলব খোলবাদককে কেন্দ্রে রেখে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে প্রণাম করলেন। এরপর বাদ্যযন্ত্রের তালে নাচের মাধ্যমে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে আসর পরিক্রমা করলেন। পরে একে একে বন্দনা গীতের পর মূল আখ্যানে বর্ণনাত্মক গীত, গদ্য ও সংলাপের মাধ্যমে চলতে থাকে পালাটি। 

মূলত পাবনা অঞ্চলে প্রচলিত পদ্মপুরাণ গানের আধুনিক রূপ পদ্মার নাচন। কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা, মিরপুর ও দৌলতপুর থানার বিভিন্ন গ্রামে পদ্মপুরাণের কাহিনি নিয়ে পদ্মার নাচন পরিবেশনার রীতি প্রচলিত। কুষ্টিয়া জেলার গ্রামে বসবাসরত কিছু কিছু পরিবার এ ধরনের নাট্যপালার পৃষ্ঠপোষক। তারা সাধারণত সন্তান কামনা, বিপদ থেকে উদ্ধার, সাপের ভয়ভীতি থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে পদ্মার নাচন আয়োজন করে। 

পরদিন মঙ্গলবার রাতে ছিল কনকনে শীত। দুপুরে রাজবাড়ী থেকে এসে পৌঁছান শিল্পীরা। দুপুরের খাবার আর কিছু বিশ্রাম নিয়ে তাঁরা নেমে যান মাঠে। শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন জমে ওঠে রাজবাড়ীর গুনাই বিবির পালা। আবদুল মাজেদ প্রামাণিক ও মো. নাজমুল হোসেনের নির্দেশনায় এ পালা দেখতে দর্শকের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। মূলত যাত্রার আদলে পরিবেশিত হয় পালাটি। গান, নাচে লোকগল্পের চলচ্চিত্রের মতোই নায়ক–খলনায়কের দ্বন্দ্ব, প্রেম, বিচ্ছেদ এবং শেষে আদালত থেকে খালাস পাওয়া—এসব মিলে জমজমাট এক পালা।

পদ্মার নাচন লোকনাট্য পরিবেশনা
পদ্মার নাচন লোকনাট্য পরিবেশনা

‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ দিয়ে শুরু
খুব চেনা সুর দিয়ে শুরু হয়েছিল উৎসব—জয় বাংলা বাংলার জয়/হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়/কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধ রাতে/নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়...। চেনা গান, তবে পরিবেশনায় ছিল নতুনত্ব। জনপ্রিয় পারকাশনিস্ট, সুরকার কাজী হাবলুর নেতৃত্বে দেশ–বিদেশের বাদ্যযন্ত্র শুরু করল গানের সুর। ড্রাম, কি–বোর্ড, গিটারের সঙ্গে বাংলা ঢোলের অপূর্ব সম্মিলন। সঙ্গে সঙ্গে শতকণ্ঠে গাওয়া হলো গানটি। অসময়ের বৃষ্টি আর শীতের তীব্রতা ভুলে উৎসবটির প্রাণ পেতে দেরি হলো না এতটুকু। দেশের গান শেষ হতেই শুরু হলো লোকগান। গানের সঙ্গে ছিল দলীয় নৃত্য। সেদিন উদ্বোধনী আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির সচিব মো. বদরুল আনম ভূঁইয়া। 

জেলাভিত্তিক পরিবেশনা, আসছেন তারকা শিল্পীরাও
উৎসবে প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্তের তিনটি জেলা, তিনটি উপজেলার শিল্পীরা অংশ নিচ্ছেন। নির্দিষ্ট জেলার পরিবেশনার আগে বড় পর্দায় প্রদর্শিত হয় সে জেলার পরিচিতি। এরপর শিল্পীরা তুলে ধরেন সে জেলার সংস্কৃতি। প্রতিটি জেলার সুপরিচিত শিল্পীরা এসে নিজের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি বিনিময় করছেন দর্শকের সঙ্গে। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী ও সংগঠনের পরিবেশনা থাকছে প্রতিদিনই। ইতিমধ্যে অংশ নিয়েছেন সৈয়দ হাসান ইমাম, খুরশীদ আলম, রফিকুল আলম, মাসুম রেজার মতো সুপরিচিত শিল্পীরা। 

আজ ৯ জানুয়ারি বেলা তিনটায় একাডেমির নন্দন মঞ্চে শুরু হবে উৎসবের সপ্তম দিনের আয়োজন। শুরুতে থাকবে লোক খেলা। বেলা চারটায় শুরু হবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। আজ অংশ নেবেন বরগুনা, দিনাজপুর ও মানিকগঞ্জের শিল্পীরা। রাত আটটায় মাঠে তৈরি প্যান্ডেলে মানিকগঞ্জের শিল্পীরা পরিবেশন করবেন গাজীর পালা। কাল শুক্রবার একই সময়ে শুরু হবে অষ্টম দিনের আয়োজন। নন্দন মঞ্চে চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও নড়াইলের শিল্পীরা তুলে ধরবেন নিজেদের সংস্কৃতি। রাত আটটায় জামালপুরের শিল্পীরা পরিবেশন করবেন খাইরুন সুন্দরীর পালা ও ঘেটুগান। এই সূচিতে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব, যেখানে নগরবাসী শহরে বসে দেখতে পাচ্ছেন গ্রামবাংলার বিচিত্র শিল্পের সুষমা। দেশের নানা প্রান্তের শিল্পীরা পাচ্ছেন কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নিজেদের প্রতিভা, ঐতিহ্য তুলে ধরার সুযোগ। 

দেখা গেছে অ্যাক্রোবেটিকও
দেখা গেছে অ্যাক্রোবেটিকও

কত পালা, কত গান
একেবারেই পাড়াগাঁয়ের বড় মেলার মতো করে আয়োজন করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব’। শিল্পকলা একাডেমির মাঠের এক পাশে প্যান্ডেল করে বানানো হয়েছে অস্থায়ী মিলনায়তন। এক পাশে টিকিটের ব্যবস্থা। ৩০ ও ৫০ টাকা টিকিটে দর্শক ঢুকতে পারেন সেখানে। কোনো রাতে এখানে জমে পালাগান, কোনো রাতে বাউলগান কিংবা পুঁথি। বিচিত্র সব পালা, লোক পরিবেশনা। রাজশাহীর আলকাপ, কুড়িগ্রামের কুশান পালা, কুষ্টিয়ার পদ্মার নাচন, রাজবাড়ীর গুনাই বিবির পালা, বরিশালের বয়ানী, মানিকগঞ্জের গাজীর পালা, জামালপুরের ঘেটুগান ও খাইরুন সুন্দরীর পালা, মাদারীপুরের নিমাই সন্ন্যাস পালা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা, গাজীপুরের সোনাভানের পুঁথি, খুলনার অস্টক পালা, নোয়াখালীর শিবের গাজন, নওগাঁর সাইদুলের কিচ্ছা, টাঙ্গাইলের সংযাত্রা, সুনামগঞ্জের ধামাইল।