আমার ভেতরটা চায় আবার মঞ্চে ফিরি: মোশাররফ করিম

মোশাররফ করিম। ছবি: সুমন ইউসুফ
মোশাররফ করিম। ছবি: সুমন ইউসুফ
অভিনেতা মোশাররফ করিম জনপ্রিয়তার স্বাদ পেয়ে আসছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। কিন্তু এত খ্যাতি, এত জনপ্রিয়তার পরও কিছু অপ্রাপ্তি, কিছু আক্ষেপ আর না বলা কথা জমে আছে তাঁর ভেতর। এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে মোশাররফ বললেন সেই ভেতরের কথাগুলোই।
কেউ নাকি মোশাররফ করিমের মনের কথাটা জানতে চান না। সবাই ওপরের মানুষটার খোঁজ নিয়েই চলে যান। কিন্তু মোশাররফের পরতে পরতে জমে আছে অনেক অনেক কথা, কবিতার পঙ্​ক্তি, গল্প, আক্ষেপ, শূন্যতা আর আনন্দের পেছনে ছুটে চলার কথা। তাঁর ব্যাপারে অনেকের অনেক অভিযোগ আছে, আছে গুঞ্জন, তর্ক–বিতর্ক। সেসব কিছুর জবাব আমাদের দিলেন এই অভিনেতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আদর রহমান ও মনজুরুল আলম

আনন্দ: এত কিছু থাকতে আপনি শিল্পী হতে চাইলেন কেন? কবে থেকে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন?
মোশাররফ করিম: ছোটবেলা থেকেই চাইতাম শিল্পী হতে। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় স্কুলে আমাকে একটি কবিতা পড়তে বলা হলো। তখন আমাকে কেউ চিনত না। আমি দুষ্টু ছিলাম, চঞ্চল ছিলাম। আমার যত দূর মনে পড়ে, সেটা ছিল চাঁদ নিয়ে একটি কবিতা। ওই কবিতাটা পড়তে গিয়ে আমি পেলাম একধরনের তৃপ্তি, যে আমার কবিতা পড়াটা হয়েছে। এই তৃপ্তি আমার চেতনের সঙ্গে অবচেতনের যোগাযোগ ঘটাল। আমি কবিতাটা পড়ে কবিতার মধ্যে ঢুকে যেতে শুরু করলাম। সেই ছোটবেলাতেই কবিতার মধ্যে ঢুকে যেতে পেরে যে আনন্দ পেয়েছি, সেই আনন্দটা একান্ত আমার, ভীষণ অন্য রকম অনুভূতি, অব্যক্ত অনুভূতি। সেই থেকেই ঠিক করে ফেললাম এই আনন্দটা আমি সারা জীবন পেতে চাই। তাই তখন থেকেই শিল্পী হওয়ার বাসনা।

আনন্দ: এই যে বললেন ক্লাস থ্রিতে আপনি কবিতা পড়তে গিয়ে আনন্দটা পেয়ে গেলেন, কিন্তু তখন আপনি সেই আনন্দ প্রকাশ করতে পারেননি। এই আনন্দ আপনি প্রকাশ করা শুরু করলেন কবে এবং কীভাবে?
মোশাররফ করিম: আসলে সত্যি কথা কী, সৃষ্টির আনন্দ প্রকাশে নয়। এটা একান্ত নিজের অনুভব। এটা নিজের কাছে নিজের প্রকাশ। এই যে ধরুন আপনাকে বললাম আজকে দারুণ অভিনয় করলাম। এই বলার চেয়েও অনেক বেশি আনন্দ হয়, যখন আমি দারুণ অভিনয়টা করে ফেলি। আমি যখন করে ফেলি সেই মুহূর্তটা অন্যকে বোঝানো মুশকিল। এ কারণে কবি আল মাহমুদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কবিকে কবিতা লিখে ফেলার পরে কবিতা সম্পর্কে আর জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। উনি যখন কবিতা লেখেন, তখন উনার দেহমন ধনুকের মতো টানটান থাকে। যখন কবি লাইনটা লিখে ফেলেন, তখন উনার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেয়।’ শিল্পীর বেলাতেও তাই। 

আনন্দ: এখন তো আপনাকে প্রতিদিন শুটিং করতে হয়, বিভিন্ন শুটিং সেটে যেতে হয়। এখনো কি সেই ‘দারুণ কিছু’ করার আনন্দটা পান?
মোশাররফ করিম: আমার প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু সেই আনন্দ প্রতিদিন পাই না। সব সময় এটা হয় না। কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় একটা লাইন আছে ‘যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।’ সেই স্বাধীনতাটি লেখার ক্ষেত্রে আছে, কিন্তু অভিনয়ে নেই। লেখার ক্ষেত্রে যেমন আপনিএকাই একজন। কিন্তু অভিনয়টা বহুজন মিলে একটা সৃষ্টি। এই বহুজন মিলে এক না হলে কাজটা পূর্ণতা পায় না। এখানে একজন পরিচালক, অভিনয়শিল্পী, ক্যামেরাম্যান, যিনি লাইট চালান তিনি, প্রডাকশন বয়—সবারই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি প্রেম থাকা লাগে। যখন সেই প্রেম জন্ম নেয়, তখনই সে কাজটি অসাধারণ হয়। তখন আমরা সবাই এক হয়ে দারুণ কিছু সৃষ্টি করার আনন্দ উপভোগ করতে পারি। কিন্তু একটা নাটকের সেটে বেশির ভাগ সময়ই কাজের প্রতি সবার সেই প্রেমাকাঙ্ক্ষা থাকে না। কিন্তু যখনই সবার ভালোবাসা একভাবে একটি কাজের মধ্যে 

মোশাররফ করিম। ছবি: সুমন ইউসুফ
মোশাররফ করিম। ছবি: সুমন ইউসুফ

আনন্দ: একটা নাটকে খুব শ্রম আর ভালোবাসা দিয়ে অভিনয় করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজটা ভালো হলো না। এই ব্যর্থতার প্রভাব আপনার ওপর পড়ে?
মোশাররফ করিম: হ্যাঁ, মন খুব খারাপ হয়। আহত হই। সেই খারাপ লাগা বেশ কিছুটা সময় আমার সঙ্গে থাকে। এরপর আবার আমি অনেক প্যাশন নিয়ে আরেকটি নতুন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে যাই। আমাদের তো প্রতিদিন শুটিং করতে হয়। এর মধ্যে দিয়েই ভুলে যেতে হয়। তবে এই আঘাতের দাগের কারণে খুব আস্তে আস্তে নিজের ভেতর গড্ডলিকা প্রবাহে চলার অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে যায়। মনে হয় এটা সব মানুষেরই হয়। সেখান থেকে বের হওয়াটা জরুরি। কিন্তু সেটাই আফসোসের কথা...কবে বের হব আমরা, সেটাই জানি না।

আনন্দ: আপনার নাট্যকেন্দ্রে ঢোকার সময়টাতে যেতে চাই। সেখানে তো হুমায়ুন ফরীদি, তারিক আনাম খানের মতো শিল্পীদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ শুরু হয়।
মোশাররফ করি: হ্যাঁ, অডিশনের মধ্য দিয়েই তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয়। ফরীদি ভাই, তারিক ভাই, আফজাল ভাই, খালেদ খান—তাঁদের আগে দেখেছি দূর থেকে। দর্শকের আসনে বসে। তাঁরা বেইলি রোডে আড্ডা দিতেন, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।

আনন্দ: থিয়েটারের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন?
মোশাররফ করিম: নাটকপাড়ায় যাওয়া–আসা ছিল। একদিন জানলাম তারিক আনাম খান নতুন একটি দল করবেন, তখনো দলের কোনো নাম দেওয়া হয়নি। যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল উচ্চমাধ্যমিক শেষ করতে হবে। কিন্তু আমি তখন মাত্র উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি, রেজাল্ট হয়নি। আমার অডিশনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা ছিল না। আমি সেটাই ফরমে লিখে ভাইভা দিতে আসি। পরে ১ হাজার ৪০০ জনের মধ্যে বাছাই করে আমরা ২৫ জন নাট্যকেন্দ্রে কাজের সুযোগ পাই। অনেক পরে তারিক ভাই একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমরা কোনো সার্টিফিকেট চাইনি। মোশাররফ চাইলে মিথ্যা বললেই পারত। সে তার সততার জন্যই দলে ঢোকার সুযোগ পায়।’

আনন্দ: হুমায়ুন ফরীদি, খালেদ খান, তারিক আনাম খানের কোনো বিষয় কখনো বিস্মিত করত?
মোশাররফ করিম: হ্যাঁ। বাইরে দেখতাম ফরীদি ভাই, তারিক ভাই, খালেদ খান মহিলা সমিতি, বেইলি রোডে আড্ডা দিচ্ছেন। আবার মঞ্চে দেখে মনে হতো ওই লোকগুলোই কীভাবে অসম্ভব শক্তিমান সব চরিত্রে অভিনয় করছেন। তখন বিস্ময় লাগত। তারিক ভাইয়ের তুঘলক, ফরিদি ভাইয়ের কেরামত মঙ্গল–এর দুর্দান্ত অভিনয় আমাকে প্রত্যেকবার বিস্মিত করত। সাধারণ মানুষেরা চরিত্রের মধ্যে কী দুর্দান্তভাবেই গলে যেতেন। তখন আফসোস লাগত। আমি যদি এই চরিত্র করতে পারতাম। এই যে তাঁদের এমন অভিনয় দেখে একটা স্বপ্নে বসবাস করতে পেরেছি, সেটার জন্য আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।

আনন্দ: এখন মঞ্চের কথা মনে হলে প্রথমে কী মনে হয়?
মোশাররফ করিম: আফসোস হয়। আমি আর ওই রকম একটি আবহের মধ্যে নেই। মঞ্চের ওই আবহ আনন্দের ছিল। আবার সেই পরিবেশে যেতে পারলে ভালো হতো। আমি হয়তো কিছু পেতাম না কিন্তু আনন্দ পেতাম। সেটাই বেঁচে থাকার জন্য খুব জরুরি। 

আনন্দ: এই যে দীর্ঘদিন মঞ্চে কাজ করেছেন, বড় বড় অভিনেতার কাজ দেখেছেন। কারও কোনো কাজ বা অভিনয় কি আপনাকে প্রভাবিত করেছে?
মোশাররফ করিম: না, তা কখনো পড়েনি। তারিক ভাই আমার অভিনয়ের শিক্ষাগুরু। কিন্তু আমার অভিনয়ের মধ্যে তারিক ভাইয়ের অভিনয়ের ছাপ নেই। তিনি আমাকে তাঁর মতো হতে শেখাননি, তারিক ভাই আমাকে শিখিয়েছেন যৌক্তিক অভিনয়, আধুনিক অভিনয়, মনস্তাত্ত্বিক অভিনয়। আমি যদি ওসব না শিখে তারিক ভাইয়ের মতো অভিনয় করাটাই শিখতাম, আমার শেখাটা ব্যর্থ হতো, ব্যর্থ হতো তারিক ভাইয়ের শিক্ষাও। শিল্প তখন বন্ধ্যত্বের মধ্যে পড়ে যেত।

আনন্দ: থিয়েটার করে আপনি আজকের অবস্থানে আসবেন, এটা ভেবেছিলেন কখনো?
মোশাররফ করিম: না। আমি কোনো কিছু ফলাফল ভেবে করি না। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘ডু ইউ লাভ টু ডু ইট?’ (তুমি কি এটা করতে ভালোবাসো?) উত্তর পেয়েছি, হ্যাঁ। আমার মন বলত মঞ্চ আমি ভালোবাসি, সে জন্য মঞ্চ করেছি। কী পাব, না পাব এটা ভাবিনি। মঞ্চে আনন্দ পেয়েছি, কাজ করেছি। টেলিভিশনে এসেছি রুটিরুজির জন্য। ওই মঞ্চের আনন্দটা যখন পাই, তখন অসাধারণ লাগে। 

আনন্দ: মঞ্চে আনন্দ পান, তাহলে কি আবার ফেরার ইচ্ছে আছে?
মোশাররফ করিম: ওই যে বললাম পরিকল্পনা করে আমার কিছু হয় না। সময় আমাকে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে টেনে নিয়েছে, আমি সেদিকেই গেছি। কিন্তু আমার ভেতরটা চায় আবার মঞ্চে ফিরি। 

আনন্দ: আপনাকে আর আপনার অভিনয় নিয়ে পরিবারে কার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি ছিল?
মোশাররফ করিম: আমার বড় ভাই আলাউদ্দিন। আমার চেয়ে ২০ বছরের বড়। ভাইয়ের উচ্ছ্বাস ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি যদি কোথাও আমার একটা নিউজ বা ছবি ছাপা হতে দেখতেন, সেটা কেটে রেখে দিতেন। 

আনন্দ: আত্মজীবনী লেখার কথা কখনো ভেবেছেন?
মোশাররফ করিম: না ভাবিনি। বেশ কজন আমাকে বলেছে কিন্তু এ বিষয়ে এখনই বলা যায় না। আমার মনে হয় অনেক মানুষ আমাকে পড়বে, জানবে তার চেয়ে আমার পরিবার আমাকে জানুক। বইটা হয়তো লিখতে চাই, তবে সেটা আমার পরিবারের জন্য। কারণ, মাঝেমধ্যেই আমার মনে হয়, পরিবারের মধ্যেই সবাই আমরা সবাইকে ভালোভাবে চিনি না। এটা আমরা মুখ ফুটে বলতেও পারি না।