এক আবেগময় সফরে মেঘনা

মেঘনা গুলজার
মেঘনা গুলজার

১৮ বছরের দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবন মেঘনা গুলজারের। কিন্তু পরিচালনা করেছেন হাতে গোনা কয়েকটি ছবি। উপমহাদেশের খ্যাতিমান কবি ও গীতিকার গুলজার আর অভিনেত্রী রাখির কন্যা তিনি। তাঁরা বাবা বলেছিলেন, বাংলাদেশের মেঘনা নদীর কথা ভেবেই মেয়ের এই নাম রেখেছিলেন। সেই মেঘনা এখন বলিউডের বাঘা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন।

ক্যারিয়ারের শুরুতেই মেঘনা গুলজার নিয়েছিলেন এক সাহসী পদক্ষেপ। ২০০২ সালে সারোগেসি (অন্যের গর্ভে সন্তান ধারণ) নিয়ে বানিয়েছিলেন ফিলহাল ছবিটি। তবে সবাইকে তিনি চমকে দেন দিল্লির আরুষি হত্যাকাণ্ডের ওপর নির্মিত তলবার ছবিটি দিয়ে। এরপর আবার একটি সত্য ঘটনা নিয়ে ছবি নির্মাণ করেন। এবার তিনি তুলে ধরেন এক কাশ্মীরি মেয়ের গল্প, যে ভারতীয় গুপ্তচর হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানে। সেই রাজি ছবি বোদ্ধাদের প্রশংসার পাশাপাশি দারুণ ব্যবসাও করে বক্স অফিসে। এবার আবারও একটি সাহসী পদক্ষেপ নিলেন মেঘনা। এবার তিনি পর্দায় নিয়ে এলেন ২০০৫ সালে অ্যাসিড হামলার শিকার অষ্টাদশী তরুণী লক্ষ্মী আগরওয়ালের মর্মস্পর্শী কাহিনি। 

বেশ সময় ও ধৈর্য নিয়ে ছপাক ছবিটি বানাতে হয়েছে মেঘনাকে। মুম্বাইয়ের একটি পাঁচতারা হোটেলে বসে মেঘনা আমাদের শোনান সেই গল্প। বলেন, ‘২০১৫ সালে তলবার ছবিটি করার সময় লক্ষ্মীর ঘটনার কথা সংবাদপত্রে আসে। প্রায় রোজই ওকে নিয়ে নানান খবর দেখতাম। কত যে জটিলতা ছিল ওর কেসটায়। কিন্তু এত কিছুর পরও লক্ষ্মী ভেঙে পড়েননি। ঘটনা নানান কারণে ল্যান্ডমার্ক কেস ছিল।’ লক্ষ্মীকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে অন্য ছবির চেয়ে একটু বেশিই পরিশ্রম হয়েছে মেঘনার। প্রথমে নাকি লক্ষ্মীকে খুঁজে বের করা ছিল একটা কঠিন ব্যাপার। এর সিনেমা নির্মাণের জন্য তাঁর সম্মতি নেওয়াটাও ছিল সময়সাপেক্ষ। মেঘনা গুলজার বলেন, ‘নির্মাণের জন্য সবার আগে আমার লক্ষীর সম্মতির প্রয়োজন ছিল। আমাদের প্রতি ওর আস্থার খুবই প্রয়োজন ছিল। এর জন্য আমাদের লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওর সম্মতি পাওয়ার পরেই আমি আর আমার সহলেখিকা ছপাক নিয়ে কাজ শুরু করি। লক্ষ্মী আর ওর সঙ্গী অলোকের সঙ্গে আমরা অনেক সময় কাটিয়েছি। ওদের মুখ থেকে অনেক গল্প শুনতাম। লক্ষ্মীর বাবা, ওর আইনজীবী ও চিকিৎসকের সঙ্গেও আমরা দেখা করি। ছবিটি নির্মাণের জন্য আমাদেরও লক্ষ্মীর জীবনের একটা অংশ হয়ে ওঠার খুব দরকার ছিল।’ 

লক্ষ্মী আগরওয়ালের চরিত্রে বলিউড অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোনকে বাছাই করার কাহিনি আমাদের কাছে তুলে ধরলেন মেঘনা। বললেন, ‘দীপিকার নাম এই চরিত্র ও ছবির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় অনেক লাভ হয়েছে। অনেকে দীপিকার জন্যই ছবিটা দেখবেন। এর বাইরেও দীপিকাকে এই ছবিতে নেওয়ার পেছনে একটা কারণ আছে। সেটা হলো দীপিকা ও লক্ষ্মীর মধ্যে এক অদ্ভুত মিল আছে। লক্ষ্মীর ওপর অ্যাসিড হামলার আগের ছবি আর দীপিকার ২০–২২ বছর বয়সের ছবি পাশাপাশি রাখলে অবাকই হতে হয়। তা ছাড়া দীপিকা হলো সৌন্দর্যের প্রতীক। ওর এই সৌন্দর্য যখন এক অ্যাসিড হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়, তখন তার প্রভাব মানুষের ওপর আরও বেশি করে পড়ে। তাই দর্শক একটু হলেও আঁচ করতে পারবেন জীবনের এই পুরোপুরি বদলে যাওয়াটা।’

মেঘনা জানান যে এই ছবি করার জন্য দীপিকাকে প্রায় আট ঘণ্টা ভারী প্রলেপের প্রস্থেটিক মেকআপ নিয়ে কাজ করতে হতো। দিল্লির অসহ্য গরমে এই ছবির শুটিং হয়েছিল। শুধু শারীরিক না, বেশ মানসিক ধকলও গেছে দীপিকার ওপর দিয়ে। 

শুটিংয়ের সময় সেটে বাস্তবের লক্ষ্মী মাঝেমধ্যেই আসতেন। কিন্তু মেঘনার পরিচালনায় কখনো হস্তক্ষেপ করতেন না। মেঘনা বলেন, ‘দীপিকাকে নিজের চরিত্রে দেখে প্রথম দিন চমকে উঠেছিলেন বাস্তবের লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর মনে হয়েছিল তিনি নিজেকে আয়নায় দেখছেন। পুরো কাজ শেষ হওয়ার পর লক্ষ্মীকে ছবি দেখিয়েছিলাম। নিজের জীবনের ওপর সিনেমা দেখে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনি। আমার জন্য এক দুর্দান্ত অনুভূতি ছিল সেটা।’ 

কথায় কথায় এসে যায় মেঘনার ব্যক্তিজীবনের কথা। চার বছরের পুত্র এবং স্বামীকে নিয়ে খুবই সুখী মেঘনা। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী অত্যন্ত প্রেরণা দেয় আমায়। আজ ও আছে বলেই আমি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি। শুটিংয়ের জন্য দীর্ঘদিন আমাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। তবে আমার ছেলে ও স্বামী আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। আর তখন আমি ভরপুর অক্সিজেন পেয়ে যাই।’ 

শুটিংয়ের শেষ দিন দীপিকা তাঁর প্রস্থেটিক মেকআপের একটা অংশ আগুনে পুড়িয়ে নিজের আবেগকে উগরে দিয়েছিলেন। তবে মেঘনা এখন পর্যন্ত এই আবেগময় সফর থেকে বের হয়ে আসেননি। লক্ষ্মীর কাহিনি এখন মেঘনার সঙ্গী।