বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সিনেমার ব্যানার

সিনেমার প্রচার-প্রচারণার সঙ্গে সিনেমা ব্যানারের সম্পর্ক। সত্তর-আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের সিনেমার সোনালি যুগে এর প্রচার-প্রচারণার জন্য তৈরি হতো বিশাল বিশাল হাতে আঁকা সিনেমার ব্যানার। উজ্জ্বল রঙে সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পোর্ট্রেট, নাটকীয় দৃশ্য ইত্যাদি এঁকে দর্শক আকর্ষণ করাই ছিল এসব ব্যানারের মূল কাজ। সাধারণত সিনেমা হলের সামনে কিংবা নির্ধারিত জায়গায় টাঙানো হতো সিনেমার ব্যানারগুলো। কাপড়ের ওপর হাতে আঁকা এই ব্যানারগুলো তৈরি করতেন মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীরা।

কিন্তু বাংলাদেশে সিনেমার দুর্দিনে সিনেমার ব্যানারের সেই সোনালি দিন আজ আর নেই। ‘কার ব্যানার কত বড়’ আর ‘কার আঁকা নায়িকার চেহারা কত সুন্দর’ ব্যানার শিল্পীদের এসব আদিখ্যেতা করার দিনও এখন অস্ত গেছে। কিন্তু পঞ্চম ঢাকা আর্ট সামিটে গিয়ে দেখা গেল সিনেমার ব্যানারের বর্ণিল উপস্থিতি। তবে এ ব্যানারে সিনেমার নায়ক-নায়িকা কিংবা ভিলেন না থাকলেও আছেন ঐতিহাসিক নায়ক-নায়িকা এবং খলনায়কেরা। সিনেমার ব্যানার আঁকার যে ধরন, তাকে অক্ষুণ্ন রেখে, সেই ক্যানভাস, রং ও রেখার বৈশিষ্ট্য মেনে, সিনেমার ব্যানার শিল্পীদের দীর্ঘদিনের অর্জন করা জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে আঁকা হয়েছে এ ব্যানারটি একটি আন্তর্জাতিক শিল্প প্রকল্পের অংশ হিসেবে।

ঢাকা আর্ট সামিটের ‘জিওগ্রাফিক্যাল মুভমেন্ট’ অংশে প্রদর্শিত হওয়া এই সিনেমার ব্যানারটি একটি যৌথ শিল্পকর্ম। জার্মানির স্যাভে কনটেম্পোরারি এবং বাংলাদেশের যথাশিল্প এই দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগ ‘এন ইনকমপ্লিট টাইমলাইন অব জিওগ্রাফিস অব ইমাজিনেশন’ শিরোনামের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন ও গ্যেটে ইনস্টিটিউট। জানা গেল, ঢাকা আর্ট সামিট শেষ হলে এটিকে বার্লিনের স্যাভে কনটেম্পোরারি গ্যালারিতে প্রদর্শন করার সম্ভাবনা রয়েছে।

‘এন ইনকমপ্লিট টাইমলাইন অব জিওগ্রাফিস অব ইমাজিনেশন’ শিরোনামের সিনেমা ব্যানার চিত্রটির একাংশ। ছবি: লেখক
‘এন ইনকমপ্লিট টাইমলাইন অব জিওগ্রাফিস অব ইমাজিনেশন’ শিরোনামের সিনেমা ব্যানার চিত্রটির একাংশ। ছবি: লেখক

‘অ্যান ইনকমপ্লিট টাইমলাইন অব জিওগ্রাফিস অব ইমাজিনেশন’ শিরোনামের এই প্রকল্পটির মূল ভাবনায় রয়েছেন স্যাভে কনটেম্পোরারির পক্ষে অ্যান্টনিও আলাম্পি, বনভেনিটউ এস বি এনডিকুঙ, ওলানি ইওনেটে এবং যথাশিল্পের পক্ষে শিল্পী ও গবেষক শাওন আকন্দ। প্রবীণ সিনেমার ব্যানার শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েবের নেতৃত্বে ১৪ জন শিল্পী এঁকেছেন এই সিনেমার ব্যানারটি। কেন এই সিনেমার ব্যানারটিকে দীর্ঘতম বলা হচ্ছে? মোহাম্মদ শোয়েব জানান, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি ঢাকাই সিনেমার ব্যানার আঁকার সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে জীবিত সিনেমার ব্যানার শিল্পীদের মধ্যে গুরুস্থানীয় এই শিল্পী জানান, তাঁর পুরো শিল্পী জীবনে তিনি এত বড় ব্যানার আঁকেননি। এই ব্যানারটির দৈর্ঘ্য ১৫৫ ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে সাত ফুট। এর আগে বাংলাদেশে এত বড় সিনেমার ব্যানার আঁকা হয়নি। টাইম ডট কম (২৩ জুলাই, ২০১৫) জানাচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সিনেমার পোস্টার তৈরি হয়েছিল ভারতে। ‘বাহুবলী’ সিনেমার সে পোস্টারটি তৈরি করা হয়েছিল ৫১ হাজার ৫৯৮.৪ বর্গফুট আয়তনের। তবে সেটি হাতে আঁকা ছিল না, ছিল মেশিনে প্রিন্ট করা। সে জন্য হাতে আঁকা সিনেমার ব্যানারের মধ্যে মো. শোয়েব এবং তাঁর দলের আঁকা এই সিনেমার ব্যানার চিত্রকর্মটিই দীর্ঘতম হওয়ার দাবিদার; যদিও এটি সিনেমার প্রচারের জন্য নির্মাণ করা হয়নি।

প্রদর্শনের সুবিধার জন্য এটি দুই ভাগে প্রদর্শিত হচ্ছে পঞ্চম ঢাকা আর্ট সামিটে। ছবি: লেখক
প্রদর্শনের সুবিধার জন্য এটি দুই ভাগে প্রদর্শিত হচ্ছে পঞ্চম ঢাকা আর্ট সামিটে। ছবি: লেখক

প্রদর্শনের সুবিধার জন্য এই সিনেমার ব্যানারটি দুটি ভাগে ভাগ করে প্রদর্শন করা হচ্ছে ঢাকা আর্ট সামিটে। এর এক দিকে রয়েছে ৯০ ফুট, অন্য দিকে রয়েছে ৬৬ ফুট। ১৫৫ ফুট দীর্ঘ এই সিনেমার ব্যানার চিত্রকর্মটিতে চিত্রিত করা হয়েছে আফ্রিকা এবং এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলাদেশের সম্পর্ক, যে সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিল কোটি কোটি বছর আগে একই ভৌগোলিক পরিসরে। এই দুই অঞ্চলের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ঘটনা পরম্পরার উপস্থিতি রয়েছে।

অ্যান্টনিও আলাম্পি, ওলানি ইওনেটে এবং শাওন আকন্দ নিজেদের কাজের সামনে। ছবি: লেখক
অ্যান্টনিও আলাম্পি, ওলানি ইওনেটে এবং শাওন আকন্দ নিজেদের কাজের সামনে। ছবি: লেখক

ভারতীয় উপমহাদেশের মতো আফ্রিকার ভাগ্যও নির্ধারিত হয়েছিল ইউরোপের ঔপনিবেশিক প্রভুদের বৈঠকখানায়। সে কারণে দেখা যায়, ১৮৮৪ সালে আফ্রিকার ভাগ্য নির্ধারণের জন্য জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কঙ্গো কনফারেন্স। যেখানে ভৌগোলিকভাবে কঙ্গো বিভাজিত হচ্ছে ইউরোপীয়দের সুবিধার জন্য। ঠিক একই ঘটনা ভারতেও ঘটানো হয় বঙ্গভঙ্গের নামে, ১৯০৫ সালে।

ইউরোপীয় উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে এই দুই মহাদেশে ঘটে যায় প্রায় একই ধরনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, জন্ম নেন পাত্রিস লুমুম্বা, নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো স্মরণকালের সেরা রাষ্ট্রনায়কেরা। স্বাধীন হয় অনেক দেশ। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য সময়কে নিয়ে একটি সময় রেখা আঁকা হয়েছে এই সিনেমার ব্যানার চিত্রে। এই সময় রেখায় জায়গা পেয়েছে মিসরীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে মহেঞ্জদারো-হরপ্পা সভ্যতার চিত্র, পাল যুগের চিত্রকলা, ভাস্কো দা গামার আগমন, কোম্পানি শাসনের পরে ব্রিটিশ শাসন, সিপাহি বিদ্রোহ, দেশভাগ, বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ, রোহিঙ্গাদের আগমন। পাশাপাশি আঁকা হয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন সংগ্রাম ও নেতার ছবি।

বাংলাদেশের প্রবীণ সিনেমা ব্যানার শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েবের নেতৃত্বে আঁকা হয়েছে দৈর্ঘ্য ১৫৫ ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে সাত ফুট আয়তনের দীর্ঘতম এই সিনেমার ব্যানার। ছবি: লেখক
বাংলাদেশের প্রবীণ সিনেমা ব্যানার শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েবের নেতৃত্বে আঁকা হয়েছে দৈর্ঘ্য ১৫৫ ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে সাত ফুট আয়তনের দীর্ঘতম এই সিনেমার ব্যানার। ছবি: লেখক

দীর্ঘ সময়ের গল্পকে এক ফ্রেমে ধরার জন্য সিনেমার ব্যানার চিত্রের বিকল্প ভাবা কঠিন। কেন এই মাধ্যম বেছে নিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে শিল্পী শাওন আকন্দ জানান, সিনেমার ব্যানারচিত্র সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করার জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে পরীক্ষিত। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার এবং এর ভিন্নধর্মী নির্মাণকৌশলের জন্য এটি এ মাধ্যমে হিসেবে অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় এ মাধ্যমটিকেই তাঁরা বেছে নিয়েছেন নিজেদের বক্তব্য প্রকাশের পথ হিসেবে।

মোহাম্মদ শোয়েব জানান, তিনি ভীষণ খুশি। কারণ তাঁর ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের শিল্পী জীবনে এত বড় ব্যানার তিনি আঁকেননি। শুধু তা–ই নয়, এই দীর্ঘ কর্মজীবনের জানা অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশে এত বড় ব্যানার আঁকার কথাও শোনেননি তিনি।