মান্না জনপ্রিয় যেসব মাপকাঠিতে

এ এস এম আসলাম তালুকদার মান্না (১৯৬৪- ২০০৮)। ছবি: প্রথম আলো
এ এস এম আসলাম তালুকদার মান্না (১৯৬৪- ২০০৮)। ছবি: প্রথম আলো

ঘটনাটি ঘটেছিল আকস্মিকভাবেই। অসময়ে প্যাক আপ হলো শুটিং। ঢালিউডকে দুঃসময়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে সেই যে চলে গেলেন মান্না, আজ এক যুগ।

২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ। রাতে শুটিং শেষ করে বাড়ি ফিরতেই বুকে উঠল চিনচিন ব্যথা। গৃহ সহকারী মিন্টু পানি এনে খাওয়ালেন মান্নাকে। একটু হাঁটাহাঁটি করে পরে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ভোর সাড়ে চারটার দিকে আবার সেই ব্যথা। মিন্টুকে ঘুম থেকে তুলে নায়ক মান্না বললেন, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। হাসপাতালে যাব। বুকের ব্যথাটা বাড়ছে।’

নিজেই গাড়ি চালিয়ে উত্তরা থেকে এলেন গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে। কিন্তু ফিরলেন প্রাণহীন হয়ে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন এ এস এম আসলাম তালুকদার মান্না। হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্রই। বিদায় নিলেন ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়ক মান্না।

আজ এক যুগ পুরলো। তখনকার দিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক মান্নাকে ছাড়া কেটে গেল এক যুগ। মোটেও ভালো কাটেনি। আজও ভালো নেই ঢাকার চলচ্চিত্রভুবন। ভালো নেই এফডিসি, ভালো নেই প্রেক্ষাগৃহ। ভালো নেই মান্নার সহশিল্পীরা। চলচ্চিত্র অঙ্গনে এখন শুধুই হাহাকার। মান্নাশূন্যতা পূরণ হয়নি আজও।

পর্দায় মান্নার আচরণে ছিল অস্থিরতা। ছবি: প্রথম আলো
পর্দায় মান্নার আচরণে ছিল অস্থিরতা। ছবি: প্রথম আলো

আসলাম তালুকদার মান্না শুধুই ‘মান্না’
১৯৬৪ সালে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে জন্ম নেন মান্না। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পরই ১৯৮৪ সালে তিনি ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন। এরপর আজহারুল ইসলাম খানের ‘তওবা’ ছবিতে অভিনয় করেন। পরে কাজী হায়াতের সঙ্গে থেকে একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে নিজেকে সেরা নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

সেই মান্না যেদিন মারা যান, তাঁকে একনজর দেখার জন্য জনতার ঢল নেমেছিল পথে। বাধ্য হয়ে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে হয়েছে, বেদনার্ত ভক্তদের লাঠিপেটা করতে হয়েছে নির্দয় পুলিশকে। দমাতে পারেনি তারা। মান্নার মৃত্যুতে জনতার ঢল নেমেছিল কেন? মান্নাই বা জীবনকালে এত জনপ্রিয় হয়েছিলেন কীভাবে? এ কথা সত্য যে মান্না ছিলেন শুধুই বাণিজ্যিক সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক, সফল অভিনেতা। বাণিজ্যিক ছবি নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন আজ। সেসব ছবির কারণে দেশের শিল্প-সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেল, এমন কথাও শোনা যেত। কিন্তু কী এক সমাজ-বাস্তবতায় বাণিজ্যিক ছবির কলাকুশলীরা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন, সেটা কি কেউ ভেবেছেন কখনো? সুবিধাবঞ্চিত মানুষ সেলুলয়েড ফিতার কেমন নায়কের মধ্যে কি নিজের মুখচ্ছবিই দেখতে পান?

মান্না শুধু অভিনেতাই ছিলেন না, ছিলেন প্রযোজকও। ছবি: প্রথম আলো
মান্না শুধু অভিনেতাই ছিলেন না, ছিলেন প্রযোজকও। ছবি: প্রথম আলো

মান্নার প্রয়াণের এক যুগ পর আবার একটু জেনে নেওয়া যাক মান্নার চিত্রনায়ক মান্না হয়ে ওঠার গল্প। জনমানুষের মান্না হয়ে ওঠার গল্প।

সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। ঢাকাই চলচ্চিত্র ঢুকে পড়েছিল অশ্লীলতার অন্ধকার গলিতে। দেশের আনাচ-কানাচে চলছিল অশ্লীল ছবি। এক শ্রেণির প্রযোজক, পরিচালক ও কিছুসংখ্যক অভিনয়-না-জানা অভিনয়কুশলীর অযৌক্তিক অশ্লীলতাসর্বস্ব ছবিগুলোর প্রতি আকর্ষণ ছিল স্কুলপড়ুয়া ছেলেদেরও। কিংবা কোনো ভালো ছবির মধ্যে ‘কাটপিস’ নামক দৃশ্য ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে দর্শকদের আমোদ দিতে চেয়েছেন কেউ কেউ।

সেই নব্বইয়ের দশকে অশ্লীল চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারা শুরু হলে যে কজন প্রথমেই এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে নায়ক মান্না অন্যতম। সে সময় মান্না রীতিমতো যুদ্ধ করেছেন অশ্লীল চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে। এসব চলচ্চিত্রের নির্মাতাদের সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিলেন। ‘আম্মাজান’ সিনেমায় ‘আম্মাজান, আম্মাজান, আপনি বড় মেহেরবান’ গানটিতে কণ্ঠে দিয়েছিলেন প্রয়াত সংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। কিন্তু এই গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে জনপ্রিয়তার চূড়া ছুঁয়েছিলেন মান্না। মান্না শুধু চলচ্চিত্র অভিনেতাই ছিলেন না, তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে যত ছবি প্রযোজনা করেছেন, প্রতিটি ছবি ব্যবসাসফল হয়েছিল। ছবিগুলো হচ্ছে ‘লুটতরাজ’, ‘লাল বাদশা’, ‘আব্বাজান’, ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’, ‘দুই বধূ এক স্বামী’, ‘মনের সাথে যুদ্ধ’ ও ‘মান্না ভাই’।

যে কারণে জনপ্রিয়তার শিখরে
মান্না অভিনীত অনেক সফল ছবির পরিচালক কাজী হায়াৎ মন্তব্য করেন, ‘মান্না পোড় খেতে খেতে ঢাকার চলচ্চিত্রশিল্পে বড় হয়েছে। একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে, তারপর সিনেমা হলে গিয়ে পড়ে থেকেছে। ছবি না চললে কেঁদেছে। যেন পরীক্ষায় ফেল করেছে। নায়ক মান্না এমনি করে মানুষের কাছে নিজেকে মেলে ধরে ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছে। “আম্মাজান” ছবি মান্নাকে অন্য রকম এক সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছে। এ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে সে এতটাই মনোযোগী ছিল যে “আম্মাজান” গানটিতে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিল।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দুজন শিক্ষক এবং বেশ কিছু শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাঁদের সে গবেষণার লিখিত রূপ ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প: সংকটে জনসংস্কৃতি’। এ বইতে লেখা হয়েছে, ওই সময়ে জনপ্রিয়তার বিচারে আর কোনো নায়ক বা নায়িকা মান্নার মতো এত সমর্থন পাননি। বইটিতে বর্তমান দশকের ‘আইকন অভিনেতা’ বলে মান্নাকে শনাক্ত করেছেন গবেষকেরা। অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প: সংকটে জনসংস্কৃতি প্রসঙ্গে প্রথম আলোতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘গবেষণার কাজে যখন আমরা ঢাকা ও আশপাশের সিনেমা হলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রেক্ষাগৃহে গিয়েছি, তখন দেখেছি, মান্না হচ্ছেন একমাত্র অভিনেতা, যাঁকে পর্দায় দেখা গেলে তুমুল করতালি পড়ে। প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের নিয়ে আমরা জরিপ করেছি, তাঁদের শতকরা ৪৫ জন বলেছেন, তাঁদের প্রিয় নায়ক হলেন মান্না।’

১৯৮৪ সালে তিনি ‘নতুন মুখের সন্ধানে’র মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন। ছবি: প্রথম আলো
১৯৮৪ সালে তিনি ‘নতুন মুখের সন্ধানে’র মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন। ছবি: প্রথম আলো

অল্প সময়ে নায়ক হিসেবে মান্না কীভাবে এত জনপ্রিয় হলেন? এমন প্রশ্ন নিয়ে আলাপ করি দেশের চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে। তাঁদের প্রায় সবাই একটি জায়গায় একমত ছিলেন যে, দর্শকদের খুব চেনা মনে হতো মান্নাকে। তথাকথিত সুদর্শন এবং ‘শুদ্ধ’ ভাষার ও নম্র সুরে কথা বলা ভালো ছাত্র ও ভদ্রলোকের চরিত্রে নয়, বরং মান্নার প্রায় সব সিনেমায় দর্শক মান্নাকে পেয়েছেন ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায়। কোনো সিনেমায় মান্না সন্ত্রাসী লালনকারী রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সৎ পুলিশ কর্মকর্তা, কোনো সিনেমায় অসৎ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বস্তি রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিবাদী যুবক, কখনো ধনীর ধন কেড়ে এনে গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া রবিনহুড। পর্দায় তাঁকে দেখা গেছে, ধর্ষককে খুন করতে। কুচক্রী প্রভাবশালীদের দমাতে। এসব দেখে সমাজের অসহায় শ্রেণির দর্শকেরা সাময়িক শান্তি পেয়েছেন, আনন্দ পেয়েছেন। বাস্তবে তাঁরা যা করতে পারেন না, পর্দায় তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে মান্না সেসব করে দেখিয়েছেন। মান্না যেন নিম্নবর্গের দর্শকের কাছে তাঁদের একমাত্র কণ্ঠস্বর।

স্বাধীনতার পর প্রায় নব্বই দশক পর্যন্ত ঢাকার বেশির ভাগ সিনেমার নায়কেরা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পরীক্ষায় ভালো ফল করে, ভালো চাকরি করতেন। কিন্তু মান্নার চরিত্রগুলো সে রকম ছিল না। তাঁর চরিত্রটি ছিল বরং উঁচু আওয়াজের খ্যাপাটে যুবকের। প্রায়ই সংলাপে থাকত খিস্তিখেউড়, আচরণে অস্থিরতা। বড় ডিগ্রি নিয়ে বড় চাকরি নয়, পর্দায় তার তাঁর সাফল্যের মাপকাঠি ছিল সমাজের অন্যায়কারীদের পরাজিত করা। মূলত এসব কারণেই খুব সহজে মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন মান্না।

বিস্মৃতির পথে মান্না
মান্নার মৃত্যুর পর ভক্তদের মাঝে হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছিল। এক যুগ পরও ভক্তদের সেই হাহাকার আজও রয়ে গেছে। তবে সহকর্মীদের কাছে মান্না যেন বিস্মৃত হতে বসেছেন। তাঁকে স্মরণ করে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী আয়োজনের খবর শোনা যায়নি। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ এফডিসিতে তাঁকে স্মরণ করে কোনো আলোচনা সভার উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। তবে কি সমাজের অন্যায় হটানো যুবকটিকে মুছে ফেলতে চায় এখনকার ঢালিউড?