থিয়েটার দিয়ে একটা দেশকে চেনা যায়

আজাদ আবুল কালাম। ছবি: খালেদ সরকার
আজাদ আবুল কালাম। ছবি: খালেদ সরকার

গানের দল ‘জলের গান’ গুরুজন সম্মাননা দিল নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা আজাদ আবুল কালামকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় জলের গানের ‘জলজ বসন্ত’ আসরে এ বছর থেকে উৎসবে যুক্ত হয়েছে গুরুজন সম্মাননা। এই সম্মাননা, থিয়েটার, নিজের দল ও বর্তমান ব্যস্ততা নিয়ে আলাপ হলো আজাদ আবুল কালামের সঙ্গে।

আপনাকে গুরুজন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কীভাবে দেখছেন?
আসলে ওরা আমার ঘরেরই লোকজন। প্রাচ্যনাট জন্মের পর থেকে যার যে ট্যালেন্ট দেখেছে, সেগুলোকে উৎসাহ দিয়েছে। তারই ফলে কেউ সিনেমার দিকে, টিভি নাটক বানানো, লেখালেখি ইত্যাদির দিকে চলে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলি, সব্যসাচী হাজরার ফাইন আর্টসে দক্ষতা। ওকে শুধু থিয়েটারের মধ্যে আটকে রাখা একধরনের বোকামি। এটা প্রথম থেকেই আমাদের নীতির মধ্যে ছিল। যার যেখানে যোগ্যতা আছে, সেখানে ফোকাস করতে বলি। যেমন অনেকবার বলার পরে সিনেমায় গেছে অনিমেষ আইচ। এ রকম অনেকেই আছে। তবে জলের গানের প্রেজেন্টেশন, সাফল্য, সংগীত পরিবেশনের নতুনত্ব—এটাও আমার কাছে থিয়েটার মনে হয়। নিজেরা নিজেরাই দিচ্ছি এ রকম মনে হচ্ছে। বাইরের কাউকে দিলে ভালো হতো। এসব নিতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য পাই না। আবার ওদের যে আগ্রহ, সেটাকেও সম্মান করতে চাই।

প্রাচ্যনাট থেকে নতুন নাটক মঞ্চে আসছে কবে?
আমি খুব কনভিন্স না হলে আমার জন্য একটা নতুন নাটক নামানো কঠিন। যদিও আমি অনেক নাটকের নির্দেশনা দিয়েছি। একটা নাটকের ভাবনা থেকে শুরু করে নতুন ভোকাবুলারি তৈরি করা পর্যন্ত আমার অনেক সময় লাগে। আমার জন্য একটা নাটক তৈরি করা খুব কষ্টের ব্যাপার। ঘুম হয় না। এই চাপ শরীরের ওপরে যায়। আমাকে যদি কেবল এই মঞ্চ নিয়েই কাজ করতে দেওয়া হয়, তাহলে বছরে তিন থেকে চারটা নাটক নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব। সে রকম উপাদানও আমার কাছে আছে। কনটেন্ট ক্রাইসিস আমার কখনো হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের অন্য জায়গায় কাজ করে খেতে হয়। তা করতে গিয়ে আমাদের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা চলে যায়। আমার দুটি মৌলিক নাটক ও রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন নিয়ে ভাবছি।

আজাদ আবুল কালাম। ছবি: খালেদ সরকার
আজাদ আবুল কালাম। ছবি: খালেদ সরকার

থিয়েটারে একটা বড় সময় পার হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে পেশাদারত্বের কোনো কিছু গড়ে ওঠেনি...
ফুলটাইম দেওয়ার একটা জায়গা থাকা উচিত ছিল। কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ ধরনের ব্যাপারে সরকারি নীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আসলে আমাদের দেশে থিয়েটারের দরকার আছে কি না; থিয়েটার দেশকে রিপ্রেজেন্ট করে কি না; থিয়েটার এ দেশের মানুষের কাজে লাগে কি না। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত থাকা দরকার। রাষ্ট্র যদি মনে করে এটা আসলে দরকারি। হাসপাতাল লাগে চিকিৎসার জন্য। হাসপাতাল, ইউনিভার্সিটিতে সরকারই ফান্ড দেয়। তাহলে থিয়েটার নিয়েও ভাবতে হবে। এটা নিয়ে সরকারের ভাবনা দরকার। এটা ছাড়া হবে না। হতে পারে যদি আবার সেই মানের কমার্শিয়াল থিয়েটারের দিকে যেতে পারে। কমার্শিয়াল থিয়েটারের দিকে যাওয়ার আবার বিপদ হচ্ছে, কমার্শিয়ালি সাকসেসফুল করার জন্য বাজে ইলিমেন্ট এটার মধ্যে ঢুকতে থাকবে। আসল জায়গাটা থাকবে না। অনেকে ব্রডওয়ে থিয়েটার নিয়ে আপ্লুত হয়। ব্রডওয়ে থিয়েটারকে একধরনের সিনেমার বিকল্প বলা যায়। কিন্তু থিয়েটার এত টেকনোলজি সম্পৃক্তও না, এত গিমিকও না। থিয়েটার হচ্ছে একটি ক্রিয়েটিভ ব্যাপার। মিনিমালিস্টিক জায়গা থেকে কোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারি, মানুষকে কী দেখাতে পারি, তার একটা চেষ্টা। ক্রিয়েটিভিটিকে এক্সপ্লোর করা। মানুষের সম্ভাবনাকে এক্সপ্লোর করা। কতগুলো যন্ত্রপাতি দিয়ে হেলিকপ্টার ওড়ানো থিয়েটারের কাজ না। সরকারের স্যালারি গ্রান্ট করা উচিত। অন্তত বাংলাদেশে ১০০ থিয়েটারের লোক আছে, যারা সরকারের কাছ থেকে বেতন পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। রাষ্ট্রীয় একটা ভাবনা এ ব্যাপারে খুবই জরুরি। বাংলাদেশের থিয়েটার একটা ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেসে আছে। আমার কোনো প্রোডাকশনকেই আমি নাটক মনে করি না। আমি মনে করি, এটা ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস। অথবা এটা ওয়ার্কস অব প্রেজেন্টেশন। আমার কাজের একটাকেও আমি কখনোই পেশাদারি থিয়েটারের মর্যাদা দিতে প্রস্তুত নই। আর সার্বিক কাজ—ইট ইজ নট আপ টু দ্য মার্ক।

সে ক্ষেত্রে আপনারা সরকারকে কোনো প্রস্তাব দিয়েছেন কি না?
কয়েকবারই ইনিশিয়েটিভ নেওয়া হয়েছে। আর সবাই তো অনবরত বলেই যাচ্ছে। এখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ভীষণভাবে দরকার। কয়েকটা শিল্পকলা একাডেমি বানালেই হবে না। ইনফ্র্যাস্ট্রাকচার থাকলেই হবে না। এখানে কারা কাজ করবে? তাদের কী হবে, তা ভাবতে হবে। শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি দিয়ে দিলাম, এটা তো হলো না। এটা দাপ্তরিক কাজ। এভাবে তো আর কাজ হবে না। এখনই এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তাঁরা যদি মনে করে হাসপাতালের দরকার আছে, এটাও বোঝা উচিত যে, থিয়েটারেরও দরকার আছে। আমরা ইংল্যান্ড বলতে প্রথম যে নামটা শুনি, সেটা হলো শেকসপিয়ারের দেশ ইংল্যান্ড। থিয়েটার দিয়ে একটা দেশকে চেনা যায়। এটা বুঝতে হবে। এটা একটা কম্বাইন আর্ট। এটাকে বলা হয় জাতির ছবি। দেশটা কেমন, তা থিয়েটার দেখলে বোঝা যায়। এটাকে বোঝার মতো যোগ্য লোকও সরকারে দরকার। আর না হলে থিয়েটার এখন যে অবস্থায় আছে, তার থেকে আর সামনে এগোবে না।

আজাদ আবুল কালাম। ছবি: খালেদ সরকার
আজাদ আবুল কালাম। ছবি: খালেদ সরকার

টিভি নাটকের বর্তমান অবস্থা কী?
ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে আছে টিভি নাটক। বাজেট একটা বিরাট ফ্যাক্টর। রুচির সমস্যা। দক্ষতার ঘাটতি—সবই আছে এখানে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোরও সক্ষমতা বা নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে ভীষণভাবে অদক্ষতা আছে। এর মাঝখানে ঢুকেছে এজেন্সি। তাদের প্রভাব আছে। সবকিছু মিলিয়ে টিভি নাটকের প্রতি দর্শকের বিমুখতা তৈরি হয়েছে। দর্শক যে খুব নাটক দেখে, তা না। কারও ইচ্ছা করলে ইউটিউবে দেখে নেয়। আর ইউটিউবের আরেক দিক হলো ভিউ। যেমন ছয় লাখ দেখল। আপনি নিশ্চিত থাকবেন, এর মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ হচ্ছে পাঁচ মিনিট কি দশ মিনিট দেখেছে। একটু টেনে দেখল আরকি। মানটা এতই খারাপ যে, বেশির ভাগ নাটকই পুরোটা দেখার মতো অবস্থায় নেই। আরেকটা ব্যাপার হলো স্ট্রিমিং সাইটগুলো কিছু আসা শুরু করেছে। এগুলোর ভবিষ্যৎ হয়তো ভালো। কারণ, এদের বাজেট একটু ভালো পাওয়া যাচ্ছে। এখানে কিছু ভালো কাজের আশা করা যেতে পারে। তারা চাইছে দর্শককে ভালো কিছু দেওয়ার জন্য। কনটেন্ট কী হবে না হবে, সেটা আপনার বিষয়। এখানে আসলে যারা নির্মাণ করতে চায়, তাদের জন্য একটা ব্রিদিং স্পেসটা আছে। চিন্তা করার জায়গা আছে। একটু ভালো কাজ করার সুযোগ আছে। এখানেও একটা ভালো ভবিষ্যৎ থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের হামলে পড়ার একটা অভ্যাস আছে। সবাই এখানে হামলে পড়ল। তারপর লেজেগোবরে করে, যা–তা অবস্থা করে ফেলল। তা ছাড়া সব ক্ষেত্রে একধরনের কুরুচির পৃষ্ঠপোষকতা বড় সমস্যা হয়ে গেছে। কারণ যে কুরুচির পৃষ্ঠপোষকতা করছে তাঁকে কেউ বলছে না, আপনি একজন কুরুচিপূর্ণ লোক, আপনি এখানে আসছেন কেন? সে তো আসছেই, এই ইন্ডাস্ট্রির দায়িত্বও নিয়ে নিয়েছে।