হলিউড বদলেছে কতটুকু?

কান চলচ্চিত্র উৎসবেও #মি টু আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করা হয়
কান চলচ্চিত্র উৎসবেও #মি টু আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করা হয়

প্রায় আড়াই বছর আগে পুরো বিশ্ব কাঁপিয়ে দিয়েছিল যৌন হয়রানির কিছু অভিযোগ। হলিউডের প্রভাবশালী প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে উঠেছিল এসব অভিযোগ। এর মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছিল #মি টু (#Metoo) আন্দোলন। কিন্তু এত দিনে ঠিক কতটা বদলেছে হলিউড? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, এখনো অনেক পথ হাঁটা বাকি।

রয়ে গেছে বৈষম্য
সম্প্রতি হার্ভি ওয়াইনস্টিনকে দোষী সাব্যস্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত রায় দিয়েছেন। সেই হিসেবে অনেকেই বলছেন, এতে #মি টু আন্দোলনের সার্থকতা কিছুটা হলেও মিলেছে। তবে তা তখনই পুরোপুরি সফল হবে, যখন হলিউডের চলচ্চিত্র শিল্পে সামগ্রিকভাবে নারীদের প্রাধান্য বাড়বে। যদিও এখনো এর লক্ষণ খুব কমই দেখা যাচ্ছে।

যেমন ধরা যাক, অস্কার, বাফটা বা গোল্ডেন গ্লোবের কথা। গত ১০ বছরের মধ্যে নবম বছরের মতো এবারও অস্কারে সেরা পরিচালক শাখায় কোনো নারী মনোনয়ন পাননি। যদিও সমালোচকেরা বলছেন, লিটল উইমেনখ্যাত গ্রেটা গারউইগ যোগ্য ছিলেন, কিন্তু একমাত্র নারী বলেই সেই সম্মান তাঁর কপালে জোটেনি।

শুধু পরিচালক নন, হলিউডি চলচ্চিত্রের অন্যান্য ভূমিকাতেও নারীরা পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে আছেন ঢের। যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব উইমেন ইন টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম সম্প্রতি একটি গবেষণা চালিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, হলিউডের অ্যাকশননির্ভর ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে এখনো পুরুষেরা এগিয়ে আছেন বিশাল ব্যবধানে। নারীদের মূলত হরর ছবি ও নাটকে মুখ্য চরিত্রে নেওয়া হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বা সায়েন্স ফিকশন ছবির ক্ষেত্রে নারীরা আরও অবহেলিত। এ–জাতীয় চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রগুলোর মাত্র ৮ শতাংশে নারীদের দেখা গেছে।

#মি টু আন্দোলনের রেশ ধরে হলিউডের নারীরা গঠন করেন টাইমস আপ তহবিল
#মি টু আন্দোলনের রেশ ধরে হলিউডের নারীরা গঠন করেন টাইমস আপ তহবিল

বদল আসছে
২০১৯‍ সালে যতগুলো চলচ্চিত্র হলিউডে মুক্তি পেয়েছে, সেগুলোর দুই-তৃতীয়াংশের প্রধান চরিত্রে ছিলেন নারীরা। সেগুলো ব্যাপক ব্যবসাসফলও হয়েছে, কিন্তু এরপরও পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় নারীরা পারিশ্রমিক পাচ্ছেন কম।

বয়সের ব্যবধানে নারীরা পিছিয়ে
রুপালি পর্দায় দেখানো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বয়স প্রদর্শনেও বৈষম্য আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ ছবিতেই নারী চরিত্রের বয়স পুরুষের তুলনায় প্রায় অর্ধেক থাকে। প্রায় ৬০ শতাংশ পুরুষ চরিত্রের বয়স দেখানো হয় ৩০ বা ৪০–এর কোঠায়, কিন্তু এর বিপরীতে নারী চরিত্রের বয়স দেখানো হয় ঠিক অর্ধেক। অর্থাৎ, পুরুষের বয়স বেশি হলে ক্ষতি নেই, নারীদের হলেই যত সমস্যা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখনো হলিউডে নারী ও পুরুষদের মধ্যকার আয়–বৈষম্য ব্যাপক। একই ধরনের কাজ করেও পারিশ্রমিক বেশি পাচ্ছেন পুরুষেরা। এমনকি বিশেষ বিশেষ চরিত্রেও নারীদের খুব একটা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, হলিউডে যদি এত স্বল্প হারে উন্নতি হয়, তবে নারী-পুরুষের পারিশ্রমিক বৈষম্য মিটতে ১০০ বছর সময় লেগে যেতে পারে।

উচ্চ পদে নেই নারী কর্মী

অবশ্য #মি টু আন্দোলনের কারণে কিছু কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন হয়েছেন নারীরা, কিন্তু সর্বোচ্চ পদে নৈব নৈব চ। ২০১৮ সালের যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে আমাজন স্টুডিওর তৎকালীন প্রধান রয় প্রাইসের বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগে রয়কে সরিয়ে দেয় আমাজন। তখন কিছুদিনের জন্য প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হয়েছিলেন জেনিফার সালকে, কিন্তু একজন নারীকে আমাজন স্টুডিওর প্রধান হিসেবে বেশি দিন রাখা হলো না। গত মাসে সনির সাবেক কর্মকর্তা মাইক হপকিন্সকে ভিডিও এন্টারটেইনমেন্ট ব্যবসা দেখভালের জন্য নিয়োগ দিয়েছে আমাজন। সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে জেনিফারকে। একই চিত্র গ্র্যামি পুরস্কার আয়োজক কর্তৃপক্ষের। তারাও এই পুরস্কার আয়োজনের প্রথম নারী প্রেসিডেন্টকে সম্প্রতি পদ থেকে অপসারণ করেছে।

ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার করা ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১৭ শতাংশ নারী হলিউডের প্রধান মিডিয়া কোম্পানিগুলোর মুখ্য নির্বাহীর পদে আছেন। আবার প্রযোজনার ক্ষেত্রেও চিত্র সুবিধার নয়। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যত চলচ্চিত্র হলিউডে নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর মাত্র ১৮ শতাংশের প্রযোজক ছিলেন নারী। আবার ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক মালিকানার ক্ষেত্রেও একচেটিয়া সুযোগ পাচ্ছেন পুরুষেরা।

২০১৮ সালে #মি টু আন্দোলনে কালো পোশাক পরে একাত্মতা জানিয়েছিলেন হলিউডের নারী শিল্পী ও কুশলীরা। ফাইল ছবি।
২০১৮ সালে #মি টু আন্দোলনে কালো পোশাক পরে একাত্মতা জানিয়েছিলেন হলিউডের নারী শিল্পী ও কুশলীরা। ফাইল ছবি।

সোচ্চার কণ্ঠে ভীরুদের ভয়

সমস্যা আরও আছে। হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর থেকে #মি টু আন্দোলনের তোড়ে হলিউডের অনেক মিডিয়া কোম্পানির শীর্ষ কর্তাকেও মানে মানে কেটে পড়তে হয়েছে। অনেকের ক্যারিয়ার ধ্বংসও হয়ে গেছে। নিন্দুকেরা বলছেন, তারপরও এসব নিপীড়কের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অভিযোগকারীরা। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগকারীদের হলিউডে কাজ পেতে সমস্যা হচ্ছে। অভিযোগ উঠছে যে কখনো প্রভাবশালী নিপীড়কেরা পর্দার অন্তরালে থেকে অভিযোগকারীদের কাজ দিতে নিষেধ করছেন। মূলত আগের প্রভাব কাজে লাগিয়েই অভিযোগকারীদের রোজগারের পথ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। আবার কখনো নিয়োগকর্তারাই অভিযোগকারীদের ‘ঝামেলা’ মনে করে কাজ দিচ্ছেন না।

হার্ভি ওয়েইনস্টিইনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছিলেন অভিনেত্রী সারাহ অ্যান ম্যাস। তাঁর মতে, যাঁরা প্রবল প্রতাপশালী এই প্রযোজকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন, তাঁদের ‘ঝামেলা’ মনে করা বন্ধ করতে হবে।

সব মিলিয়ে এটি বলাই যায় যে হলিউডে এখনো বৈষম্যের জাঁতাকলেই পিষ্ট হচ্ছেন নারীরা। হয়তো #মি টু আন্দোলনের কারণে সেই বিরুদ্ধ পরিবেশে কিছুটা পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে, কিন্তু তা প্রবল হচ্ছে না। ফলে ঝাঁ–চকচকে হলিউডে কলঙ্কের দাগ রয়েই যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ভ্যারাইটি, উইফোরাম, সিএনএন ও হলিউড রিপোর্টার