এবার রমনার বটমূলে গাইবে না ছায়ানট, হবে না মঙ্গল শোভাযাত্রা

রমনার বটমূলে এবার আর এমন দৃশ্য দেখা যাবে না। ফাইল ছবি
রমনার বটমূলে এবার আর এমন দৃশ্য দেখা যাবে না। ফাইল ছবি

পঞ্জিকার শাসন মেনে এবারও নতুন বছর আসবে। বাংলা ১৪২৬ সালের সূর্য ডুববে, হাসবে ১৪২৭ সালের সূর্য। আসবে পয়লা বৈশাখ। কিন্তু মানুষ মিলবে না রমনার বটমূলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ১৯৭১ সালের পর এবারই প্রথমবার বছরের প্রথম প্রহরে রমনার বটমূলে গান শোনাবে না ছায়ানট। গানে গানে করবে না নতুন বছরের বন্দনা।

চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রাও বের হবে না। বাংলা একাডেমিতে জমবে না বৈশাখী মেলা। হবে না সারা দেশে সাংস্কৃতিক জমায়েত। দেশের সাংস্কৃতিকসেবীরা বলছেন, মানুষ বাঁচলে ভবিষ্যতে অনেক পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন করা যাবে। দেশের প্রধানমন্ত্রীও মানুষের কল্যাণে নববর্ষের সব আয়োজন বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল মঙ্গলবার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে দেশের ৬৪টি জেলার জেলা প্রশাসকদের ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী নববর্ষের সব অনুষ্ঠান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নববর্ষের অনুষ্ঠান আমরাই শুরু করেছিলাম। কিন্তু তাও আমাদের বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মানুষের কল্যাণেই এ অনুষ্ঠান না করার অনুরোধ আপনাদের।’

চারুকলা অনুষদ থেকে বেরোবে না মঙ্গল শোভাযাত্রা। ফাইল ছবি
চারুকলা অনুষদ থেকে বেরোবে না মঙ্গল শোভাযাত্রা। ফাইল ছবি

রমনার বটমূলে ছায়ানটের বৈশাখবরণ শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চলাকালে বৈশাখবরণ অনুষ্ঠানটি হয়নি। এবার ছায়ানট বর্ষবরণের প্রস্তুতিও শুরু করেছিল। নির্ধারিত হয়েছিল গানের তালিকাও। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার আয়োজন করি। বর্তমানে পরিস্থিতিতে আমরা মানুষের স্বার্থে এবং শিল্পীদের স্বার্থে সংগঠনের সভাপতি সন্‌জীদা খাতুনের উপদেশ অনুযায়ী অনুষ্ঠানটি করব না বলে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ সারওয়ার আলী বলেন, ‘ছায়ানট মানুষের জন্য নিবেদিত সংগঠন। এখন বরং আমরা মনে করি সাধারণ মানুষ, যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। সে লক্ষ্যে থেকে আমরা একটি সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে এদের পাশে দাঁড়িয়েছি। এটা অনেকটা আমাদের বৈশাখ আয়োজনে যে খরচ হয়, সেটি বিবেচনায় নিয়ে করেছি ছায়ানটের ত্রাণ তহবিল থেকে।’

সাধারণত পয়লা বৈশাখের এক মাস আগে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। মার্চের ১৪ তারিখে আনুষ্ঠানিক শুরু হয়। কেননা, এ আয়োজনের তহবিল গঠন করা হয় চারুকলা অনুষদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী আঁকা ছবি ও শিল্পকর্ম বিক্রি করে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সুনসান নীরবতা। কোনো কার্যক্রম নেই। চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘আমাদের আয়োজনের প্রস্তুতিও গণমানুষের অংশগ্রহণে হয়। মানুষ আসে, ছবি কেনে। তা দিয়ে তহবিল সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তো শোভাযাত্রা করার মতো নয়। আমরা শোভাযাত্রায় মানুষকে আহ্বান করি একটি জায়গায় মেলার জন্য। আর এখন এক জায়গায় মিলতে চাওয়া তো একটা আত্মঘাতী কাজ হবে।’

শিশুপার্কের সামনে ঋষিজের আয়োজনে থাকবে না মানুষের জমায়েত। ফাইল ছবি
শিশুপার্কের সামনে ঋষিজের আয়োজনে থাকবে না মানুষের জমায়েত। ফাইল ছবি

১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে প্রথমবারের মতো মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ২০১৬ সালে ইউনেসকোর অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হয়। মাঝে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ে নীতিগত দ্বন্দ্বে চারুকলা সামনে না করে ক্যাম্পাসের বাইরে গ্যালারি শিল্পাঙ্গন থেকে বের হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা।

শিশুপার্কের সামনে সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ দীর্ঘদিন ধরে নববর্ষ উদ্‌যাপনের আয়োজন করে আসছিল। সংগঠনটির প্রধান ফকির আলমগীর জানান, এবার নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছেন। তবে তাঁরা গণমানুষ নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন না। ধারণ করে টেলিভিশনে প্রচারের মাধ্যমে বিকল্প উপায়ে অনুষ্ঠানের কথা ভাবছেন। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবার বৈশাখী মেলা বসবে না বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী।

এ ছাড়া করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে না সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটও। জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের কোনো আয়োজন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট করবে না, এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। তিনি বলেন, ‘অনুষ্ঠান জীবনের চেয়ে বড় না। মানুষ বাঁচলে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে বৈশাখ উদ্‌যাপন করা যাবে। মানুষের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে আমরা এবার সব বাতিল করেছি।’