নায়ক হয়েছেন দিলদার, আর বাকি কমেডিয়ানরা

খান জয়নুল। ছবি: সংগৃহীত
খান জয়নুল। ছবি: সংগৃহীত

বিনোদনধর্মী ছবিতে একজন কমেডিয়ান যেন থাকতেই হয়। গল্পের উত্তেজনায় দর্শকের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলে কমেডিয়ানের কাজ হচ্ছে একটু স্বস্তি ছড়িয়ে দেওয়া। পর্দায় কমেডিয়ানের এমন ভূমিকা দেখেই দর্শক অভ্যস্ত। ষাটের দশক থেকেই এ দেশের সিনেমায় কমেডিয়ানের দাপট। কখনো কখনো নায়ক-নায়িকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে গেছেন কমেডিয়ানরা। এ রকম কজন কমেডিয়ানের অন্য পরিচয় সম্পর্কে জানাব আজ। যাঁরা কেবল হাসি-তামাশা করেই সিনেমাজীবন কাটিয়ে দেননি, মাঝেমধ্যে কাজের পরিধিতে যোগ করেছেন বৈচিত্র্য।

ষাটের দশকের কমেডিয়ানদের কথা বললে যাঁর নাম সবার আগে আসে, তিনি খান জয়নুল। ক্ষণজন্মা এই পুরুষ তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ করেছেন পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশের দর্শকদের। ‘দর্পচূর্ণ’, ‘মধুমালা’, ‘ময়নামতি’, ‘অন্তরঙ্গ’সহ অনেকগুলো ছবিতে হাসির খোরাক জোগান দিয়েছেন তিনি। কমেডিয়ানের বাইরেও তাঁর পরিচয়, তিনি ছিলেন একজন কাহিনিকারও। ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’–এর মতো বিখ্যাত হাসির ছবির কাহিনিকার খান জয়নুল। এমনকি ‘পূর্বাণী’ পত্রিকায় কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন তিনি।

আনিস। ছবি: সংগৃহীত
আনিস। ছবি: সংগৃহীত

আনিসের নাম বাদ দিয়ে ষাটের দশকের অভিনেতাদের তালিকা করা যাবে না। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় অভিনয় করে তিনি পুরো দেশের মানুষের মন জয় করেছিলেন। ‘জরিনা সুন্দরী’, ‘জংলি মেয়ে’, ‘সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল’, ‘অবাঞ্ছিত’, ‘অঙ্গার’, ‘বারুদ’, ‘উজানভাটি’, ‘লাল কাজল’সহ বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন আনিস। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চলচ্চিত্র সম্পাদক হিসেবে প্রাথমিক জীবন শুরু করেছিলেন তিনি।

টেলি সামাদ কমেডিয়ান হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। ‘সোহাগ’, ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘অশিক্ষিত’, ‌‘চন্দ্রলেখা’, ‘কথা দিলাম’, ‘ভাত দে’ ছবিগুলোতে অভিনেতা হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর হাসির অভিনয়ের পেছনে আড়াল হয়েছে তাঁর গায়ক পরিচয়। অনেকগুলো ছবিতে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘মনাপাগলা’ ছবিতে গান গেয়েছেন টেলি সামাদ। তা–ও আবার যে সে গায়িকার বিপরীতে নয়, সাবিনা ইয়াসমীনের মতো শিল্পীর সঙ্গে। ‘মনাপাগলা’ ছবিটি প্রযোজনাও করেছিলেন টেলি সামাদ। এ ছবিতে তিনি নায়কও হয়েছিলেন। কাজী হায়াতের আরেক ছবি ‘দিলদার আলী’তেও নায়ক তথা নাম ভূমিকায় টেলি সামাদই অভিনয় করেছেন। এখানেও তিনি গান গেয়েছেন। সেই গানের সুরও তিনি নিজে করেছিলেন।

হাসমতের বোকা বোকা অভিনয় ছাড়া এ দেশের সিনেমার ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হয় না। ‘হাবা হাসমত’ নামে কেবল পরিচিতিই পাননি, এই নামে একটি ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন। তাঁর আরও কিছু বিখ্যাত ছবির মধ্যে অন্যতম ‘এতটুকু আশা’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘বিনিময়’, ‘আলোর মিছিল’। অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিচালনাও করতেন হাসমত। তাঁর পরিচালিত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘এখানে আকাশ নীল’, ‘হাসিকান্না’, ‘নকল মানুষ’, ‘মধুমিতা’ ইত্যাদি। তাঁর পরিচালিত শেষ ছবি ‘বউ হবো’।

দিলদার। ছবি: সংগৃহীত
দিলদার। ছবি: সংগৃহীত

এবার বলা যাক দিলদারের কথা। ছবির সংখ্যার দিক থেকেও রেকর্ডটি তাঁর দখলে। ‘লড়াকু’, ‘যন্ত্রণা’, ‘ত্রাস’, ‘তেজী’, ‘খায়রুন সুন্দরী’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’সহ কয়েক শ ছবিতে কমেডিয়ান হিসেবে দর্শকেরা পেয়েছেন দিলদারকে। নারী কমেডিয়ান নাসরিনের সঙ্গে জুটি বেঁধে শতাধিক গানেও পারফর্ম করেছেন তিনি। তাঁর জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে নূতনের বিপরীতে তাঁকে নায়ক বানান ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ ছবির পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল। ‘আবদুল্লাহ’ নামের সেই ছবি হিট হয়ে গেলে বেশ সাড়া পড়ে যায়।

টেলি সামাদ। ছবি: সংগৃহীত
টেলি সামাদ। ছবি: সংগৃহীত

এ তো গেল কমেডিয়ানদের কথা। আরেক ধারার অভিনেতা আছেন, যাঁরা হাসির অভিনয়ও করতেন আবার গুরুগম্ভীর অভিনয়ও করতেন। এ সুযোগে তাঁদের কথাও কিছুটা বলা যেতে পারে। পরিচালক সুভাষ দত্ত তাঁদের অন্যতম। ‘সুতরাং’–এর মতো ছবিতে তিনি যেমন নায়ক, বহু ছবিতে আবার তিনি স্রেফ দর্শক হাসানোর কাজটি করেছেন। তবে তাঁর পরিচালক পরিচয়টি এসবের ভিড়ে হারিয়ে যায়নি। বরং এ দেশের শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের নাম নিতে গেলে তাঁর নাম আসবেই। একই কথা খাটে আমজাদ হোসেনের বেলাতেও। বহু ছবিতে গুরুগম্ভীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। আবার শুরুর দিকে অনেক ছবিতে লোক হাসানোর কাজও করেছেন সার্থকভাবে। ‘জীবন থেকে নেয়া’য় তাঁর অভিনয় দর্শক ভুলে যাননি। অথচ অভিনেতা নয়, তাঁর পরিচয় তিনি এ দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে।

হাসমত অভিনীত ছবি ‘হাবা হাসমত’–এর পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
হাসমত অভিনীত ছবি ‘হাবা হাসমত’–এর পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

এ বেলায় আশীষ কুমার লৌহর নামটিও নেওয়া যায়। তিনিও হাসির অভিনয় করতেন। যদিও তাঁকে শুধু কমেডিয়ান বলা যায় না। তিনিও অভিনয়ের পাশাপাশি গল্প, সংলাপ, চিত্রনাট্য লিখতেন। এ টি এম শামসুজ্জামানকে লোকে কৌতুক অভিনেতা, খলনায়কসহ নানা বিচিত্র চরিত্রে দেখতে পেয়েছেন। এসবের বাইরে তাঁর আরেকটি প্রতিভা ছিল। তিনি একজন চিত্রনাট্যকার। ‘সীমার’–এর মতো প্রশংসিত ছবির চিত্রনাট্য তাঁর লেখা।

এতক্ষণ যাঁদের কথা বলা হলো, একমাত্র এ টি এম শামসুজ্জামান ছাড়া তাঁদের সবাই প্রয়াত। বাংলাদেশের শিল্প–সংস্কৃতির অঙ্গনে তাঁদের অবদান কম নয়, বিশেষ করে চলচ্চিত্রে।