'বাঁচার ক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্বই হচ্ছে প্রধান ওষুধ'

কুমার বিশ্বজিৎ। ছবি: সংগৃহীত
কুমার বিশ্বজিৎ। ছবি: সংগৃহীত

এখন আমরা রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। পৃথিবীর নানা প্রান্তে সবাই নিজেদের যেভাবে রক্ষা করছে, আমাদেরও সে পথেই হাঁটতে হবে। আমাদের সবার মধ্যে জনসচেতনতা আরও অনেক বাড়াতে হবে। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি এলাকায় এলাকায় মাইকিং করাটাও উপকারে আসবে। আমরা সামাজিক দূরত্বের কথা বলছি, এটা তো আসলে শারীরিক দূরত্ব। করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে এই শারীরিক দূরত্বই হচ্ছে প্রধান ওষুধ।

আমাদের কারোরই এখন আর অক্ষমতা, ভুলভ্রান্তি, দোষত্রুটি ধরার সময় নাই। এরই মধ্যে আমাদের যা হওয়ার হয়েছে, এটাকে প্রতিরোধ করতে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা। করোনাভাইরাস এমন একটি অদৃশ্য শত্রু, যার কারণে একটি পরিবার, একটি কমিউনিটি, একটি এলাকা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। প্রতিবেশী এবং সর্বোপরি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একজন করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তি যদি নিয়ম অমান্য করেন, তাহলে যাঁরা ১৪ দিন করে ঘরে থাকছি, তাঁদের পরিশ্রম বৃথা যাবে। এই একজনের জন্য আরও ১৪ দিন ঘরে আটকে থাকতে হবে। নিয়ম অমান্য করার কারণে ১৪ দিনের সময়টা দীর্ঘায়িত হবেই। ১৪ দিনের ঘরে থাকায় যত না কষ্ট হবে, তখন তার চেয়ে বড় ভোগান্তিতে আমাদের পড়তে হবে। আলটিমেটাম পরের অধ্যায়গুলো আরও ভয়ংকর।

আমাদের অর্থনৈতিক সংকটটা সবচেয়ে বড় আকার ধারণ করবে। এই অথর্নৈতিক সংকট বিভিন্ন সেক্টরে হবে। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ওরা কাউকে কিছু বলতেও পারে না, সইতেও পারে না। আমাদের সেক্টর নিয়ে তো ভাবতেই পারছি না। একটা বছর কী যে হবে। এই এক বছর সারভাইভ করা কতটা ডিফিকাল্ট হবে...।

কুমার বিশ্বজিৎ। ছবি: সংগৃহীত
কুমার বিশ্বজিৎ। ছবি: সংগৃহীত

এখন বিশ্বায়নের যুগ। সারা পৃথিবীতে কিছু হলে, আমরা যেহেতু সেই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, তার আঁচ আমাদের গায়েও লাগবে। ওটাই হবে দীর্ঘ যুদ্ধ। ওটাতে টিকে থাকাটা ভয়াবহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। যেকোনো রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তিকে দিনের পর দিন সাহায্য সহযোগিতা করে বাঁচাতে পারে না। করোনার কারণে আমরা এমনও দেখব, যাঁর ক্ষমতা আছে কিন্তু যখন চাকরিচ্যুত হবেন, এতে করে হতাশা বাড়বে। হতাশার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বেন। এটা কিন্তু একটা বিরাট ক্ষতি। অনেক ছেলেমেয়ে ক্লাস করতে পারছে না। এক বছরের একটা ধাক্কার মধ্যে পড়ে যাবে। অভিভাবকেরা সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে টেনশনে পড়বেন। এই যে একটা বছর পিছিয়ে যাওয়া, এটা অনেক বড় ক্ষতি। আছে আরও অনেক ধরনের ক্রাইসিস। সব ক্রাইসিস হিসেব করলে, কোনোভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে কম না।

কুমার বিশ্বজিৎ। ছবি: সংগৃহীত
কুমার বিশ্বজিৎ। ছবি: সংগৃহীত

যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের বিমান হামলা করার আগে একটু হলেও খবর পাওয়া যায়, দেখা যায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধটা অদৃশ্য। ভয়াবহ শক্তি, কিন্তু কেউ খালি চোখে দেখছি না। এটা থেকে সামলে নেওয়া সত্যিই বেশ কঠিন। তবে আমরা বীরের জাতি, যুদ্ধ জাতি। ঐতিহাসিকভাবে হয়তো আমরা ঝড়ঝাপটা, বন্যা, খরা, যুদ্ধ অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছি। তার পরও বারবার যুদ্ধ করলে একটা সময় মানসিক শক্তি থাকে না। আর এটা তো এমন যুদ্ধ, প্রতিপক্ষকে দেখাই যায় না। আমি তো যুদ্ধ দেখেছি। কিন্তু ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে যেভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে দেখছি, তা বিপজ্জনক।

আমরা স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের পিলাডেলপিয়াতে। আর আমি উত্তরায় ছেলেকে নিয়ে আছি। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ঘরে। বাচ্চার দেখাশোনা, খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা, মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা সবই আমাকে করতে হচ্ছে। আছে পুরো বাড়ি ঠিক রাখা, বাজার সদাই আছে কি না। আমার বাড়িতেও কয়েকজন ফিক্সড কাজের লোক আছে। ওদের পরিবার আছে-তাদের খোঁজখবর রাখা, যা আমার স্ত্রী করত। একটা বাড়ির যে সংকট দেখি, যখন দেশের বিষয়টা আসে, বিশ্বের কথা বাদই দিলাম- কেমন যেন লাগে।

আমাদের যে পেশা এটা হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে শেষের দিককার চাহিদা। প্রয়োজনীয় সবকিছু পাওয়ার পর মানুষ বিনোদন নিয়ে ভাবে। সুতরাং আমরা, কবে যে মানুষ গান শোনার পর্যায়ে যাবে, তা এই মুহূর্তে ভাবতে পারছি না। সবশেষে বলতে চাই, মানসিক বল রাখা উচিত। পৃথিবীতে যা-ই আসুক না কেন, তার মোকাবিলা তো করতেই হবে। আমি বলব, মৃত্যুই সবচেয়ে বড় সত্য, কিন্তু মরার আগে যাতে না মরি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চারদিকে তৈরি হয়েছে সংকট। এই সংকটের মধ্যে অনেক সংগঠন নানাভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি বিত্তবানদের কাছে আহ্বান জানাব, আপনারাও নিজ থেকে এগিয়ে আসুন। সবাই সবার পাশে দাঁড়ান। সবাই মিলে আমাদের দেশটাকে বাঁচাতে হবে।

আর একটি কথা, বেশি বেশি টেস্ট করাতে হবে। টেস্ট টেস্ট এবং টেস্ট—এটা যত বেশি হবে, ততই ভালো। একই সঙ্গে করোনাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু নতুন শব্দের সঙ্গে বিশ্বের সবার মতো বাংলাদেশিরাও পরিচিত হয়েছে। শব্দগুলো হচ্ছে কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিসটান্স, লকডাউন। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের এসব শব্দের অর্থ বুঝতেই কষ্ট হয়। আমি বলব আমাদের দেশের উপযোগী করে কিছু শব্দ কিংবা একদম আঞ্চলিকরূপে মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে পারলে ভালো হয়। এতে বেশির ভাগ মানুষ সহজে ব্যাপারগুলো বুঝতে পারত। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা কিন্তু আমরা কেউ উপলব্ধি করতে পারছি না। এর ভয়াবহতা যে কত মারাত্মক, তা সবার মাথায় যদি সহজে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, সহজেই নিস্তার পেতে পারব।