যেভাবে এইচএমভিতে লাকী আখান্দ্

লাকী আখান্দ্ ।ছবি: সংগৃহীত
লাকী আখান্দ্ ।ছবি: সংগৃহীত

বয়স কম, কিন্তু সুরের সঙ্গে যেন আজন্ম আলাপ তাঁর। হোক তা পিয়ানো কিংবা হারমোনিয়াম, সামনে পেলেই বসে যেতেন, শুরু করতেন বাজাতে। শুরু করার সুযোগ দেওয়া হোক, এ রকম একটি আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে ঘুরতেন। কিন্তু দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হতো তাঁকে। পাকিস্তানি এইচএমভির বয়স্ক গীতিকারদের কাছে গিয়ে লাকী আখান্দ্ বলতেন, 'চাচা, আমাকে একটা গান দেবেন?' ঠাট্টা করে তাঁরা বলতেন, 'তোমার স্কুলের কবিতার বই আছে না? ওখান থেকে কবিতা বেছে শুরু করো।' খুব বিরক্ত লাগত, তাই সেখানেই পিয়ানো দেখলে বসে যেতেন। কিন্তু খুব দ্রুত তাঁকে বকা দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হতো।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মে মাসে তিনি কলকাতায় গেলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা করলেন সমর দাসের সঙ্গে। সমর দাস বললেন, 'এখন এখানে সুরকার লাগবে না। তুমি চলে যাও! আমরা মন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং করে তারপর তোমাদের জন্য কিছু করব।' 'আমি তো টাকাপয়সা কিছুই নিয়ে আসিনি! আমি কি রাস্তায় থাকব?' অবাক হয়ে বলেছিলেন লাকী আখান্দ্। উত্তর ছিল, 'এখন যাও, পরে আমরা ব্যবস্থা করব!' শ্যামল মিত্রের ঠিকানা জোগাড় করে গিয়েছিলেন আকাশবাণীতে। শ্যামল মিত্র তাঁর কথা শুনে বললেন, 'আপনি আমার এখানে এসেছেন কেন? সরাসরি এইচএমভিতে গেলেই তো পারেন!' খুবই মন খারাপ হয়ে গেল লাকী আখান্দের। শ্যামল মিত্রের চোখে চোখ রেখে বললেন, 'আমি আপনার গান গেয়ে বড় হয়েছি। আপনি আমার সবকিছু। আপনি যদি এভাবে কথা বলেন, তাহলে আমি একা একাই চলে যাব।' শ্যামল মিত্র নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। ১৫-১৬ বছর বয়সী ছেলেটির হাতে তুলে দিলেন একটি চিরকুট। তাতে লিখলেন, 'ওকে দিয়ে কিছু সম্ভব হলে করবেন!'

শ্যামল মিত্র চিঠিটা তুলে দিতে বললেন প্রতিষ্ঠানের সন্তোষ সেনগুপ্তের হাতে। লাকী আখান্দ্ চিঠিটা দিলেন। সন্তোষ সেনগুপ্ত তা দেখে বললেন, 'বসুন।' তারপর চা–বিস্কুট এল। ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে একটা ব্রেক হলো। সে সময় হাতের কাছে একটা হারমোনিয়াম দেখে যেন পাগল হয়ে গেলেন লাকী আখান্দ্। চারদিক ভুলে একমনে বাজাতে লাগলেন হারমোনিয়াম এবং একের পর এক গাইতে লাগলেন গান। সুরকার ও গীতিকার অভিজিৎ ব্যানার্জি (হেমন্তের কণ্ঠে যাঁর বিখ্যাত গান 'সবাই চলে গেছে শুধু একটি মাধবী তুমি' ও 'আমিও নদীর মত হারিয়ে যাব') লাকী আখান্দের সাক্ষাৎকার নিলেন। শিল্পীরাও লাকীর গান শুনতে ভিড় করেছেন ওই ঘরে। এ সময় হাসতে হাসতে সন্তোষ সেনগুপ্ত সেখানে হাজির হলেন। বললেন, 'তোমার জন্য শিল্পী ঠিক করে ফেলেছি। বনশ্রী সেনগুপ্ত আর গোরাচাঁদ মুখার্জি দুটো করে তোমার সুরে গান গাইবেন!' এইচএমভিতে এভাবেই ঢুকে গেলেন এই তরুণ। হাওড়া সার্কিট হাউসের একচিলতে একটি ঘরে থাকার ব্যবস্থাও হয়ে গেল লাকী আখান্দের।