অজস্র নিদ্রাহীন চোখ !

এজাজ মুন্‌না
এজাজ মুন্‌না

লেখার শুরুতেই গ্যালিলিওর একটা উক্তির কথা মনে পড়ছে- 'ইউ ক্যাননট টিচ এনিবডি এনিথিং, অনলি মেক দেম রিয়ালাইজ দ্য আনসার আর অলরেডি ইনসাইড দেম' (আমরা কাউকে কিছু শেখাতে পারি না, শুধু অনুধাবণ করাতে পারি যে সব উত্তর আছে আমাদের ভেতর)। আজকের করোনাকালে আমরা টের পাচ্ছি হাঁড়ে হাঁড়ে। সংকটে সবাই। আমরাও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু আমরা নৈরাশ্যবাদীও নই। আমরা আশা নিয়েই পথ চলি। পৃথিবীর তাবৎ নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে আমরা খুজেঁ বেড়াই ইতিবাচক দিকগুলো। আমরা মনে করি, আজকে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার হয়ত একটা সমাধান অচিরেই আসবে। আসলে, যে পরিস্থিতিগুলোকে সমাধান বলে মনে হয় তার প্রতিটি যে সমাধান, তা নয়। আবার যে পরিস্থিতিগুলোকে সমস্যা বলে মনে হয়, তার প্রতিটি যে সমস্যা তা-ও নয়। জীবন আমাদের দিকে অনেক কিছু ছুঁড়ে দেয়। সব কিছু আমাদের পছন্দের হয় না। জীবন নানান কিছুই আমাদের দিকে ছুঁড়তে পারে। কিন্তু তা দিয়ে আমরা কি বানাবো সেটা শতভাগ নির্ভর করে আমাদের ওপর। আমাদের অগ্রজেরা এই টেলিভিশন মাধ্যমটিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁরা আমাদের বোধে নাড়া দিয়ে বুঝিয়ে ছিলেন জীবন তোমার দিকে যা কিছু ছুঁড়ুক সেটাকে অসাধারন মাত্রায় পরিবর্তন করবে। সেই ছু্ঁড়ে দেওয়া জিনিসগুলো গ্রহণ করবে। হতে পারে সেটা ভালো কিছু নয়, কিন্তু তোমরা সম্ভাবনা তৈরি করবে ভালো কিছু করার। কারণ মানুষই পারে। আমরা স্বপ্ন দেখাই, সম্ভাবনা তৈরি করি। আজ সেই সম্ভাবনা, স্বপ্ন হোচঁট খেয়েছে; তবে হারিয়ে যায়নি। যতদিন এই পৃথিবী থাকবে ততদিন স্বপ্নরা মৃত নয়, সম্ভাবনাও দূরে নয়। 

আমরা নাটকের মানুষেরা সাময়িক বিচলিত, তবে আমাদের স্বপ্ন দেখা থেমে নেই। কিন্তু দৈব দুর্বিপাকে অসহায়ত্বের চরমে পৌঁছে আমরা চার্লি চ্যাপলিনের মতো বৃষ্টিতে কাদিঁ, যাতে কেউ না বুঝতে পারে। আমরা বিনোদন কর্মী (এন্টারটেইনার)। আমরা ব্যক্তিজীবনের সব শখ, আহ্লাদ, দুঃখ, শোক, পাশে রেখে উঠে দাড়াঁই ক্যামেরার সামনে। আমাদের জীবনে দুঃখ থাকতে নেই। কষ্ট থাকতে নেই। প্রেম-ভালোবাসা, পরিবার-পরিজন কিচ্ছু থাকতে নেই। আমাদের সন্তানেরা খিদেয় কাদেঁ না! তাদেঁর জন্য আহারের প্রয়োজন পড়ে না! কারণ আমরা অদ্ভুত জীব। আমাদের কাজ বিনোদন দেওয়ার। একটা সময় আমরা হারিয়ে যাব। গিরীশচন্দ্র ঘোষ বলেছিলেন 'দেহপট সনে নট সকলি হারায়!'


বিখ্যাত শিল্পী আমেদিও মদিগিলিয়ানি তাঁর জীবদ্দশায় ক্ষুধার তাড়নায় খাবারের জন্য নিজে শিল্পকর্ম একেঁ দিতেন। তাঁর শিল্পকর্মের তাৎপর্য মানুষ বুঝতে পারে, তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৯৫ বছর পর। এবং রেকর্ড দামে তা বিক্রিও হয়। আমরাও অপেক্ষায় আছি একদিন হয়ত আমাদেরও মূল্যায়ন হবে। কিন্তু এখন যে দুঃসময়ের মধ্যে আমরা আছি, মূল্যায়ন দূরে থাক, বাচঁবার উপকরণ তো চাই। কেবল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে। এই যে মানুষে মানুষের দূরত্ব তৈরি করলো করোনাভাইরাস। এই দূরত্বই কাল হয়ে দাড়াঁলো আমাদের। কারণ আমাদের পেশার নিরাপত্তা নেই, নেই স্বীকৃতি। যখন কোনো মহামরি বা প্লাবন আসে তখন কোথায় গিয়ে দাড়াঁবো আমরা? আমাদের নাট্যকারেরা আর লিখছেন না। আমাদের অভিনেতারা সংলাপ বলছেন না। আমাদের প্রযোজকেরা টাকা লগ্নী করছেন না। আমাদের রূপসজ্জা শিল্পীরা হাত ধুচ্ছেন ঘন ঘন। এই বুঝি কেউ এলো, মেকাপ দিতে হবে! না কেউ আসেনি। আলো জ্বলেনি। ক্যামেরা রোল হয়নি। পরিচালকের চেয়ার শুন্য। এ এক ঘোর অমানিশা।


এমন একটা দেশের কথা কি আমরা ভাবতে পারি, যে দেশে নাটক নেই, শিল্পমাধ্যমের কোনো শাখা নেই? না, এমনটা আমরা ভাবতে পারি না। যদি শিল্প-সংস্কৃতিহীন সমাজ না ভাবতে পারি তাহলে সেই মাধ্যমের মানুষগুলোকেও তো মানুষই ভাবতে হবে। তাঁরা তো রোবট তো নয়। যদি আমরা মানুষ হয়ে থাকি তাহলে আমাদেরও অন্য সবার মতো একটা ঘর আছে। সেই ঘরে বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান সবই আছে। অতি সৌভাগ্যবানদের আছেন বৃদ্ধ দাদা-দাদী কিংবা নানা-নানী। এই এত শত মুখ তাকিয়ে থাকেন কর্মক্ষম মানুষটির দিকে। কিন্তু সেই কর্মক্ষম মানুষটি আজ অসহায়। তাঁর কাজ নেই। কাজ নেই তো টাকাও নেই। এই কথা কি পেট মানবে? মানে না। মানবে না। তার খাবার চাই। তার প্রোটিন চাই। শক্ত সামর্থ্য শরীর চাই। খাবারের জন্য দরকার টাকা। সেই টাকা কোথা থেকে আসবে আমরা কেউ জানি না। আমরা এক অসহায় অদ্ভুত জীব। আমরা অভিনয়শিল্পী, আমরা নাট্যকার, আমরা প্রযোজক, আমরা পরিচালক, আমরা নেপথ্য কুশীলব।


দেশে অনেকগুলো চ্যানেল হওয়ার ফলে একটা সম্ভাবনা তৈরি হলো। সেই সঙ্গে তৈরি হলো অনেক শিল্পী-কলাকুশলীর, যাঁরা এই মাধ্যমটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন। ধীরে ধীরে অনলাইন প্লাটফর্ম সংহত হতে লাগলো কর্মক্ষেত্র বাড়লো। বিদেশি অনুষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের অসম প্রতিযোগীতায় ফেলে দেওয়া হলো। বিদেশি অনুষ্ঠানের বিশাল বাজেটের বিপরীতে আমরা দাঁড়ালাম ক্ষুদ্র বাজেট নিয়ে। তারপরও আমরা আমাদের চিন্তাশক্তি দিয়ে গল্পভাবনা এবং নির্মাণের চমৎকারিত্ব দিয়ে দর্শককে ধরে রাখার চেষ্টা করতে থাকলাম। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাও প্রশ্নের মুখে। আজকে অনেক টেলিভিশন চ্যানেলও অর্থনৈতিক দৈনতায়। এই দৈনতা থেকে উত্তোরনে পে-চ্যানেলের বিকল্প নেই। বিদেশি অনুষ্ঠান অনলাইনে চলে আসার কারণে অনেক দর্শক আমাদের টেলিভিশন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। দিশেহারা নাট্যকার-নির্দেশক-প্রযোজকেরা সূত্র খুজঁতে লাগলেন, কী উপায়ে দর্শক ফিরিয়ে আনা যায়। কিছু টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার শুরু হলো বিদেশি ভাষার অনুষ্ঠান, বাংলায় ডাবিংকৃত সিরিয়াল। আমাদের কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হলো। নাটক নির্মাণ আগের চেয়ে কমে গেলো। ক্ষতিগ্রস্থ হলেন এই মাধ্যমের মানুষেরা। যাঁরা আশা নিয়ে এসেছিলেন, অনেক সম্ভাবনা দেখিয়েও হতাশায় নিম্মজ্জিত হলেন। কিন্তু যাওয়ার তো জায়গা নেই। কষ্ট করেই আকঁড়ে ধরে রাখলেন এই মাধ্যমটিকে। দিনমজুরের মতো মেধাবী তরুণটি কিংবা বৃদ্ধটি সারাদিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করে গেলেন দর্শকদের আনন্দ দেওয়ারর জন্য। দিন শেষে যোগ্য সম্মানী না পাওয়ার বেদনা উবে যায় তখন, যখন কেউ বলে আপনি- 'অনেক ভালো অভিনয় করেন'। কিন্তু আজ কে বলবে 'আপনি ভালো অভিনয় করেন', 'আপনি খুব ভালো লেখেন', 'আপনি খুব ভালো পরিচালক'। কেউ বলার নেই। কারণ কাজটাই তো বন্ধ। কিন্তু বন্ধ নেই কেবল পেট।


সে অভুক্ত থাকতে চায় না। সে মোরগ পোলাও চায় না। চায় কেবল বেচেঁ থাকার জন্য এক মুঠো ভাত আর একটু লবণ। মুখ ফুটে বলতে পারে না। দিনমজুর তো! তাই তো আমরা আড়াঁল খুজিঁ। যত ক্লেশ, দুঃখ, শোক, জরা, ব্যাধি আড়াল করে আমরা মুখে রঙের প্রলেপ দিই দর্শককে বিনোদিত করবো বলে। এই যে এতগুলো বছর ধরে ধীরে ধীরে এই মাধ্যমটিকে শক্ত অবস্থানে দাড় করালো এক দল সৃজনশীল মানুষ। তাঁদের পেশার নিরাপত্তা কোথায়? চাকুরীজীবিরা অবসর ভাতা পান। কিন্তু নাটকের মানুষেরা যখন অবসরের সময় আসে তখনও বাধ্য হয়ে বৃদ্ধ বয়সেও কাজ করতে চান। কিন্তু সেই বাজেটে বৃদ্ধদের জায়গা নেই। শেষ জায়গা হয় সম্মানীত দুঃস্থশিল্পী কলাকুশলীর খাতায়। যাঁরা উত্তরাধিকার সূত্র বহন করে বাঙালি শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করলেন বিশ্ব আসনে, তাঁরা আজ অনেকেই অসহায়। যাঁরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সব আগ্রাসন রুখতে দেশের ঐতিহ্য লালন করেন তাদেঁর জীবন বুঝি এভাবেই অন্ধকারে অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার জন্য?


একটা মহামারিই যথেষ্ট আমাদের শেষ করে দেয়ার জন্য। আজকে অনেক কিছুই ঠিক থাকতো যদি আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত থাকতো। কিন্ত আমাদের তা নেই। আমাদের অধিকাংশ শিল্পী-কলাকুশলী এখনও দিন হিসাবে সম্মানী পেয়ে থাকেন। কাজ নেই, অর্থও নেই। আর শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি বেশিরভাগ কলাকুশলীর জন্য চিন্তা করাই বাহুল্য। আমরা তো অনেকটা শেষ হয়েই আছি বিদেশি অনুষ্ঠানের আগ্রাসনের কারণে।


স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এই মাধ্যমটি সবার প্রিয় মাধ্যম হিসেবে শক্ত অবস্থানে ছিলো। আজ সংকটে নিপতিত হয়ে এই মাধ্যমের মানুষগুলো নিরুপায় হয়ে অন্য পেশায় চলে গেলে একটা বিশাল শুন্যতা তৈরি হবে। তখন এই মাধ্যমটি কি আর ঘুরে দাড়াঁতে পারবে? এই সব বিষয়বুদ্ধিহীন আবেগ তাড়িত শিল্পী কলাকুশলীর কী হবে? যারা নিজের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে পেশার নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে জীবনের প্রায় পুরোটা সময় এই মাধ্যমে নিরলস কাজ করে চলেছেন। পেছনে ফিরে তাকাননি। শতকষ্ট বুকে নিয়ে কেবল মাত্র ভালোবাসাটাকে কর্তব্য জেনে রাঙিয়ে গেছেন এই ভূবন।


যে অগ্রজদের বিছানো পথে অনুজেরা নির্ভাবনায় হাঁটবে, আজ তাঁরা দ্বিধান্বিত। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে বাঁচার পথ তো রুদ্ধ! কে দেখাবে মুক্তির পথ? টেলিভিশনের মানুষগুলোও যে 'মানুষ' এই কথা কাকে বলবো? তারাঁও কারো ভাই, কারো বোন, কারো বাবা, মা, স্ত্রী, স্বামী, বন্ধু, প্রিয়জন। তাঁর ঘরটিও আজ নিকশ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত। আলো ছাড়া কি বাচাঁ যায়? সেই আলোর খোজেঁ নিঃস্ব আমরা তাকিয়ে অজস্র নিদ্রাহীন চোখ।
লেখক: নাট্যকার ও নির্দেশক