এক্সট্রাকশন দেখতে পারেন; 'এক্সপেকটেশন' ছাড়া

এক্সট্রাকশন সিনেমার পোস্টার।
এক্সট্রাকশন সিনেমার পোস্টার।


গত ৪৮ ঘণ্টায় বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গরম করে রেখেছে নেটফ্লিক্সের একটি সিনেমা, এক্সট্রাকশন। হলিউডের স্ট্যান্টম্যান স্যাম হারগেভের পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবি। এর আগে তিনি ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার (২০১৬), অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেমে (২০১৯) স্ট্যান্ট কো–অর্ডিনেটরের কাজ করেছেন। তাই সিনেমায় গল্প, সংলাপ যা-ই হোক না কেন, অ্যাকশন যাঁদের প্রিয়, তাঁরা ১ ঘণ্টা ৫৭ মিনিটের এই ছবি দিব্যি গিলে ফেলতে পারবেন। কারণ, সিনেমার প্রায় ৮০ ভাগ জুড়েই মার–মার, কাট–কাট অ্যাকশন।


ছবিটি মূলত প্রযোজনা করেছেন হলিউডের জনপ্রিয় দুই ভাই, এন্টনি রুশো আর জো রুশো। অভিনেতা ক্রিস হেমসওর্থ নিজেও এই ছবির অন্যতম প্রযোজক। আর পরিচালক স্যামও এই ছবিতে দেখা দিয়েছেন অভিনয়শিল্পী হিসেবে। সিনেমার মূল গল্প মূলত ২০১৪ সালে প্রকাশিত সিউদাদ নামের এক উপন্যাস থেকে নেওয়া।

স্প্যানিশ শব্দ সিউদাদ অর্থ শহর। তাই প্রথমে এই ছবির নাম ছিল ঢাকা। চিত্রনাট্যকার জো রুশো এই গল্প নিয়ে বই প্রকাশেরও আগে ২০১২ সালে একটা সিনেমা করতে চেয়েছিলেন। সেই ছবিতে টাইলার চরিত্রের জন্য ডোয়াইন জনসনকে চুক্তিবদ্ধও করা হয়েছিল। সিনেমাটির গল্প ছিল প্যারাগুয়ের প্রেক্ষাপটে। ছয় বছর পর প্যারাগুয়ের জায়গা নিল ঢাকা। আর ডোয়াইন জনসন হয়ে গেলেন অস্ট্রেলীয় অভিনেতা, ৩৬ বছর বয়সী ‘থর’ ক্রিস হেমসওর্থ। বইয়ে, এক মাফিয়ার মেয়েকে অপহরণ করে লুকিয়ে রাখা হয় পৃথিবীর নিকৃষ্ট স্থানে। তাই বলে, বাংলাদেশের ঢাকা সেই নিকৃষ্ট স্থান কেন সেটা পরিচালকই ভালো বলতে পারবেন।

এক্সট্রাকশন সিনেমা নিয়ে একটা সিনেমার গ্রুপে দ্বন্দ্ব লেগেছে। তাই সেই গ্রুপে এই সিনেমা নিয়ে আলাপ নিষিদ্ধ করেছে অ্যাডমিন।
এক্সট্রাকশন সিনেমা নিয়ে একটা সিনেমার গ্রুপে দ্বন্দ্ব লেগেছে। তাই সেই গ্রুপে এই সিনেমা নিয়ে আলাপ নিষিদ্ধ করেছে অ্যাডমিন।

পর্দায় এই মাফিয়া চরিত্রে দেখা দিয়েছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি। তার ১৪ বছর বয়সী ছেলে অভি মহাজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বাংলাদেশের ড্রাগ মাফিয়া আমির আসিফ। পঙ্কজ ত্রিপাঠি জেলে বন্দী। তাই বাইরে থেকে তার সব কর্ম (পড়ুন অপকর্ম) দেখাশোনা করে তার প্রধান সহকারী রণদীপ হুদা। রণদীপ হুদার ওপর দায়িত্ব পড়ে বসের ছেলে অভিকে বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার করে আনার। রণদ্বীপ তাই টেইলর রেকরূপী ক্রিস হেমসওর্থকে ভাড়া করে নিয়ে আসে। টেইলরের স্ত্রী, সন্তান, পরিবার কেউ নেই। কোনো পিছুটানও নেই তার। আর এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার জন্য বিশ্বে সে-ই সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। শুরু হয় সিনেমা।


প্রায় পুরো সিনেমার ব্যাকড্রপে ঢাকা। কিন্তু এই ঢাকা ঢাকা শহরবাসীর অজানা, অচেনা। অবশ্য ঢাকায় শুটিংও প্রায় হয়নি বললেই চলে। যদিও রুশো ভাইয়েরা ও স্যাম হারগেভ একাধিকবার ঢাকা ঘুরে গেছেন। তাঁদের মনে হয়েছে, এই শহরে আর যা-ই হোক, ছবির হিরোদের নিয়ে শুটিং করা সম্ভব নয়। তাই স্টাবলিশমেন্টের জন্য কিছু প্লেট শট নিয়েছেন। ক্রোমায় সেখানে বসিয়ে দিয়েছেন অভিনেতাদের। আর ভারতের আহমেদাবাদে বানিয়ে ফেলেছেন পুরান ঢাকা। ২০১৮ সালের নভেম্বরে সেখান থেকেই শুরু হয় শুটিং। তা ছাড়া কিছু অংশের শুটিং হয়েছে থাইল্যান্ডে, ভারতের মুম্বাইয়ে ও অন্ধ্রপ্রদেশে।

পুরান ঢাকায় ক্রিস হেমসওর্থ।
পুরান ঢাকায় ক্রিস হেমসওর্থ।

সিনেমার প্রথমেই দেখা গেল ঢাকার কংক্রিটের জঙ্গল। সেখানেই শুরু, সেখানেই শেষ। এরপর দেখা গেল কেবল বস্তি, ট্রাক, বাস আর অসংখ্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ঢাকার রাস্তায় সংলাপ বলতে কেবল গালাগালি। দেখা গেল পুলিশ, এলিট (র‍্যাবের মতো একটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী)—সবাই মিলে কাজ করছে ঢাকার মাফিয়ার হয়ে। ভারতের মাফিয়ার ছেলেকে যাতে নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য পুরো ঢাকা লকডাউন করে রাখা। ঢাকা যেন ঢাকা নয়। সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে কলোম্বিয়ার মেডেলিন সিটির মতো, ড্রাগ লর্ড পাবলো এসকোবাররূপী আমির আসিফের রাজত্ব। ঢাকাতে ঢাকার বিশেষ কিছু নেই। নেই হাতিরঝিল, উঁচু উঁচু দালানকোঠা, শপিং মল বা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি। রিকশার শহর ঢাকা হয়ে গেছে অটোরিকশার শহর। তা–ও সেই অটোরিকশার পেছনে লেখা, ‘নাসিব পরিবহন’। বা সাইনবোর্ডে লেখা ‘এই দোকান বিক্রি হবে’।


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলকালাম পড়ে গেছে এই সিনেমায় ভুল উচ্চারণে বাংলা নিয়ে। না ঢাকাইয়া, না কলকাতার, না সিলেটি, না ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা। অনেকে বলছে, এই সব বাংলা ব্লেন্ডারে মিক্স করলেও পুরোপুরি এই ছবির বাংলার মতো হবে না। এই সিনেমা নিয়ে ট্রল, মিম করোনার মতোই ছড়িয়ে পড়ছে অন্তর্জালের দুনিয়ায়। ভাইরাল হচ্ছে দোকান, বাস, অটোরিকশা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাকের ভুল বানান নিয়ে। মূল ব্যাপার হলো, নেটফ্লিক্স দক্ষিণ এশিয়ার বাজার ধরার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে নেটফ্লিক্সে। কলকাতার সিনেমাতেই কেউ কোনো দিন ঠিকমতো বাংলাদেশের বাংলা শুনেছেন কি না সন্দেহ। আর এ তো হলিউডের ছবি। তা–ও আবার বস্তির পোলাপান মাস্তান থেকে শুরু করে, আমির আসিফ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—এই ছবিতে একজনও বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পী নেই। সে জন্যই বাংলাদেশের ড্রাগ লর্ডের চেয়ে ভারতের ড্রাগ লর্ড অধিক শুদ্ধ উচ্চারণে ‘ঢাকা'’বলেন। যিনি জীবনে বাংলা বলেননি, শোনেননি, তাঁর কাছ থেকে শুদ্ধ বাংলা আশা করায় আশাভঙ্গ হয়েছে কোয়ারেন্টিনে ঘরে থেকে নেটফ্লিক্স দেখা দেশের অসংখ্য সিনেমাভক্তের। তারা রীতিমতো খুঁজে খুঁজে ভুল ধরে সেগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে অন্তর্জালের দুনিয়ায়।

একটা ছবিতেই (স্টিল পিকচার) অন্তত তিনটি ভুল। বন্ধুকের নল তাক করে ভিউফাইন্ডারে টার্গেট দেখছেন, কিন্তু ডান চোখ খোলা। তার পোশাকে একই সঙ্গে তিন বাহিনীর নাম। এর ভেতর একটা আবার ‘আর্মি ফোর্স’।
একটা ছবিতেই (স্টিল পিকচার) অন্তত তিনটি ভুল। বন্ধুকের নল তাক করে ভিউফাইন্ডারে টার্গেট দেখছেন, কিন্তু ডান চোখ খোলা। তার পোশাকে একই সঙ্গে তিন বাহিনীর নাম। এর ভেতর একটা আবার ‘আর্মি ফোর্স’।

হাস্যকর লেগেছে, ঢাকার রাস্তায় দেশি ‘ক্ষুদে মাস্তান’দের সঙ্গে ক্রিস হেমসওর্থের কথোপকথন ও মারামারি। আপনার অঢেল সময় থাকলে আপনি গুনে ফেলতে পারেন, এক অভিকে বাঁচাতে গিয়ে কত লোক পাখির মতো টপাটপ মারা পড়ল। আর রাস্তার লোকজনের তাতে কিচ্ছু আসল গেল না।


ভারত আর বাংলাদেশের মাদক মাফিয়ার ঠিক কী নিয়ে সংঘাতের শুরু, সেই প্রশ্ন করবেন না। কারণ, সিনেমার গল্প, সংলাপ, অভিনয় এখানে অবান্তর। কেবল গালাগালি, মারামারি আর ভিএফএক্স সর্বস্ব। অনেকে ফোড়ন কেটে বলছেন, চিত্রনাট্য নাকি সেটে গিয়ে লেখা। ঢাকা শহরে বুড়িগঙ্গা আর সদরঘাটের পাশে এক জঙ্গলে রণদ্বীপ হুদা, ক্রিস হেমসওর্থ আর অভিকে অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে যুদ্ধ করতে দেখা যায়। অনেকে এই জায়গাটা খুঁজছেন। কেবল শহরের বস্তি আর রাস্তাঘাট দেখালে চলবে? লোকেশনে বৈচিত্র্যও তো দরকার। যুদ্ধ করতে করতে পুরান ঢাকার একাধিক বাড়িতে ঢুকে পড়েছে ক্রিস আর পুলিশের লোক। সেই সব বাড়িতে বেজেছে ‘আঁখিয়োসে গোলি মারে’, ‘এক লাড়কিকো দেখা তো এইস্যা লাগা’, ‘দিদি তেরা দেবর দিওয়ানা’, ‘মেহেন্দি লাগাকে রাখনা, ডোলি সাজাকে রাখনা’—বলিউডের পুরোনো দিনের এসব হিট গান।

অভিকে বাঁচাচ্ছে রণদীপ হুদা
অভিকে বাঁচাচ্ছে রণদীপ হুদা

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ এক সদস্য, যে কিনা আমির আসিফের ‘ডান হাত’ হয়ে কাজ করে, তার একটা ছবিতেই (স্টিল পিকচার) অন্তত তিনটি ভুল। বন্ধুকের নল তাক করে ভিউফাইন্ডারে টার্গেট দেখছে, কিন্তু ডান চোখ খোলা। তার পোশাকে একই সঙ্গে তিন বাহিনীর নাম। বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে সুলতানা কামাল ব্রিজ। সিনেমায় দেখানো হয়েছে, সেই ব্রিজের এক পাশে ভারত, আরেক পাশে বাংলাদেশ। সিনেমার সুবিধার্তে কল্পনা করে নিন না! আপনি কেন মার্কিন একটা বাণিজ্যিক সিনেমায় বাস্তব খুঁজে সময় নষ্ট করছেন?


সিনেমায় ইরানি অভিনেত্রী ‘নিক খানে’র প্রয়োজনীয়তা খুঁজতে যাবেন না। একইভাবে রণদীপ হুদার স্ত্রীর কী প্রয়োজন ছিল, এই প্রশ্নও করবেন না। পুরো সিনেমায় একটা মাত্র চুমুর দৃশ্য তো রণদীপ হুদা আর তার স্ত্রী নেইসারই, নাকি? অনেকে আবার হা–হুতাশ করে বলছেন, কাজী মারুফ বা রুবেলের সিনেমাতেও যদি একটু ভালো অ্যাকশন ডিরেক্টর আর সিনেমাটোগ্রাফার থাকত, তাহলেই সেগুলো নেটফ্লিক্সে এক্সট্রাকশনের আশপাশেই কোথাও জায়গা করে নিতে পারত।


এত সমালোচনার ভিড়ে অনেকে আবার মার্কিন একটা বাণিজ্যিক সিনেমায় ঢাকা শহরের রূপ, সংস্কৃতি দেখার আশা করার জন্যই দুষছেন। যেখানে বাংলাদেশি সিনেমাতেই ঢাকা শহর সেভাবে উঠে আসেনি। অনেকে আবার বলছেন, তাহলে বাংলাদেশ থেকে গবেষণার দল কী করল? বাংলা ভাষা যাঁরা দেখাশোনা করছেন, তাঁরা কী করলেন? নিদেনপক্ষে দু–একজন বাংলাদেশি অভিনয়শিল্পীকে নিলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত? ঢাকা শহর নিয়ে এত বাজে গবেষণা কেন? এসব প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এত কিছুর পরেও হলিউডের রথী–মহারথীদের হাতে বানানো, সাড়ে পাঁচ শ কোটির বেশি বাজেটের একটা বড় আয়োজনের ছবিতে যে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ‘ঢাকা শহর’ দেখা গেল, সেটুকুই–বা খারাপ কী। যদিও যাঁরা ছবিটা দেখেছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই বলছেন, ‘যা দেখিয়েছে তা আর যা-ই হোক, ঢাকা শহর নয়।’ আপনি যদি এখনো এক্সট্রাকশন না দেখে থাকেন, তো দেখতে পারেন। এক্সট্রাকশন দেখুন কোন ‘এক্সপেকটেশন’ ছাড়া, নিজ দায়িত্বে।