আমাদের সেক্টরের প্রণোদনা নিয়ে কেউ কিছু ভাবছে না

আবুল হায়াত। ছবি: সংগৃহীত
আবুল হায়াত। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের চিন্তাভাবনা, কার্যক্রম এমন একটা পরিস্থিতিতে চলে গিয়েছিল, প্রকৃতিগভাবে একটা নাড়াচাড়া ভীষণ প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়। অনেকেই বলেন, প্রকৃতির ওপর আমরা অনেক অত্যাচার করেছি, জগদ্দল পাথরের মতো বসে গেছি। করোনা অছিলায় তাই প্রকৃতি নিজে থেকে একটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। আমার এও মনে হয়, এটা অবধারিত ছিল। তবে পৃথিবীতে এই নাড়াচাড়া কীভাবে আসবে, তা আমাদের জানা ছিল না। যদিও অনেকে নানা সময়ে ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিল, এখন সেসবের কথা শোনা যাচ্ছে।

সৃষ্টির পর থেকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর মাঝেমধ্যে পৃথিবী এমন নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে। করোনাভাইরাসে সে রকমই কিছু একটা হয়েছে। এটা আবার নিশ্চয় মানুষকে নতুন করে উপলব্ধি করতে বাধ্য করবে, আসলে আমরা যা করছিলাম এত দিন, ঠিক ছিল কি না। নিজেদের চিন্তাভাবনাকে বদলানোর একটা সুযোগ হয়তো আসবে, সবকিছুর ব্যাপারে। সবচেয়ে বেশি চিন্তা আসবে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে। এমনও মনে হয় দুনিয়াটা বোধ হয় আর আগের মতো থাকবে না। আমার কেন জানি মনে হয়, করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটলে, পৃথিবীটা কিছুদিন অন্য কোনো দিকে মোড় নেবে। তবে আমি বিশ্বাস করি, এটা মঙ্গলময়ই হবে।

প্রথমত, অর্থনৈতিক একটা বড় ধাক্কা আসবে, এটা স্বীকার করতেই হবে। আমাদের মতো দেশে এরই মধ্যে তা দৃশ্যমান। করোনায় ঘরবন্দী অবস্থায় একটি মাস পার করেছি, তাতেই দারিদ্র্য প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে, মানুষ যে কত অসহায়, তা–ও দেখা যাচ্ছে। একটি মাস বা একটি দিন রোজগার করতে না পারলে কী অবস্থা হয়, তা অনেকে নতুনভাবে দেখছেন।

বিনোদন অঙ্গনের কথা চিন্তা করলেও ভাবি, সবচেয়ে কম পারিশ্রমিক নিয়ে যে কাজ করছে, একজন প্রোডাকশন বয়, তার জন্য যা, আমার জন্যও তা। একদিনে সে বা তারা যা রোজগার করে খরচ করে, আমি বা আমরাও যা রোজগার করি—খরচই করি। অথচ এই অঙ্গনের সমস্যাটা নিয়ে কেউ সেভাবে কথা বলছে না। এই অঙ্গনটা যে গভীর সমস্যায় পড়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও পড়তে যাচ্ছে, এদের নিয়ে কেউ চিন্তা করছে না। চিন্তা করছে, গার্মেন্টেসের মালিক, যাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ব্যবসা করেন। মুনাফা করেন। বিদেশে বাড়ি–গাড়ি করেন। তাঁদের নিয়ে সবার যত মাথাব্যথা। তাঁদের নিয়ে চিন্তা করতে সমস্যা নেই, কিন্তু অন্য ক্ষেত্র নিয়েও ভাবতে হবে। আমাদের বিনোদন অঙ্গনের দিকে এখন পর্যন্ত কেউ তাকাচ্ছে বলে দেখলাম না। দিন আনে দিন খাওয়া, কেউ কম খায় কেউ বেশি খায়, তাদের নিয়ে যে সৃজনশীল জগৎ এটা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। কীভাবে সংকট কাটিয়ে উঠব। এই মুহূর্তে আমাদের এটা নিয়ে ভাবতে হবে। মানুষ তাঁর জমানো টাকাপয়সা কত দিন খরচ করবেন।

আবুল হায়াত। ছবি: সংগৃহীত
আবুল হায়াত। ছবি: সংগৃহীত

সরকার প্রণোদনা সব ক্ষেত্রে দিচ্ছে। আমাদের সেক্টরের প্রণোদনা নিয়ে কেউ কিছু ভাবছে না। আমাদের সংগঠনগুলো কিছু সবার মধ্যে থেকে চাঁদা তুলে নিজেদের মতো কাজ করে যাচ্ছে। কোনোভাবে পরিস্থিতি ম্যানেজ করছে। কিন্তু এরপর কী হবে। প্রতি মাসে তো আর এভাবে সম্ভব না। লাখ কোটি টাকার ঘোষিত প্রণোদনায় সংস্কৃতির অঙ্গনের কোনো নাম তো দেখি না।

এখন রোজার মাস, সামনে ঈদ—এই একটা মাস এই অঙ্গনের সবাই অনেক ব্যস্ত থাকেন। আয় করেন। টাকা জমা করেন। কিন্তু করোনার কারণে এবার সেই সুযোগ নেই। এদিকে শুনছি, এই ঈদে চ্যানেলগুলো পুরোনা নাটক প্রচার করবে। চ্যানেল কিন্তু ঠিকই তাঁর সময়টা ঠিক করে নিয়েছে। এই নাটকগুলোতে যাঁরা সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের রয়্যালিটি কোথায়। চ্যানেলগুলো তো প্রথমেই চুক্তি করে নেয়, কোনো রয়্যালিটি চলবে না। করোনাকাল পার হলেই শুরুতেই শিল্পীদের রয়্যালিটির বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে। এভাবে গা ছেড়ে দিয়ে কাজ করব, এমন চিন্তা যেন আর না থাকে। নিজেদের আরও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। আমাদের সংগঠনগুলোকে আরও কঠোরভাবে ভাবতে হবে।


লেখক: অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার ও পরিচালক