একদিন তাঁরা সিনেমার নায়িকা ছিলেন

চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে তাঁদের খ্যাতি দেশজোড়া। একনামেই তাঁদের পরিচিতি। চরিত্রাভিনেত্রী পরিচয়ের নিচে হারাতে বসেছে তাঁদের অন্য অর্জন। একসময় তাঁরাও ছিলেন সেলুলয়েডের নায়িকা। তাঁদের জন্যও সিনেমা হলে পড়ত করতালি। এই প্রতিবেদনে এমন কয়েকজন নায়িকার কথা।

সুমিতা দেবী ঢাকাই সিনেমার প্রথম দিককার অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা। ছবি: সংগৃহীত
সুমিতা দেবী ঢাকাই সিনেমার প্রথম দিককার অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা। ছবি: সংগৃহীত

সুমিতা দেবী
সুমিতা দেবী ঢাকাই সিনেমার প্রথম দিককার অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা। কিন্তু তিনি দ্রুত নায়িকা পরিচয় থেকে বেরিয়ে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তবু এ দেশের নায়িকাদের ইতিহাস লিখতে গেলে তাঁকে দিয়েই শুরু করতে হয়। কারণ, তিনিই প্রথম জনপ্রিয়তার চূড়ায় বসেছিলেন। ১৯৫৭ সালে এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে তাঁর নায়িকা হিসেবে অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু তাতে কাজ করা হয়নি তাঁর। ‘আসিয়া’ ছবিতে প্রথম অভিনয় শুরু করেছিলেন। ছবিতে তাঁর নায়ক ছিলেন শহীদ। মুক্তির দিক থেকে ‘আকাশ আর মাটি’ তাঁর প্রথম ছবি। ছবিতে তাঁর নায়ক ছিলেন আমিন ও প্রবীর কুমার।
‘আকাশ আর মাটি’ এবং ‘আসিয়া’ ছবির পর সুমিতা দেবী নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছিলেন ‘এ দেশ তোমার আমার’ (বিপরীতে আনিস), ‘কখনো আসেনি’ (বিপরীতে আনিস), ‘সোনার কাজল’ (বিপরীতে খলিল), ‘সঙ্গম’ (বিপরীতে খলিল), ‘কাচের দেয়াল’ (বিপরীতে আনোয়ার হোসেন) ছবিতে। এ ছাড়া সুমিতা দেবীর নায়িকা হিসেবে ছবির মধ্যে রয়েছে ‘এই তো জীবন’, ‘অভিশাপ’, ‘অশান্ত প্রেম’, ‘দুই দিগন্ত’, উর্দু ছবি ‘ধূপছাঁও’, ‘জনম জনম কি পিয়াসী’ ইত্যাদি।

ষাটের দশকেই ধুয়েমুছে যায় রোজী আফসারীর নায়িকা হিসেবে পরিচিতি। ছবি: সংগৃহীত
ষাটের দশকেই ধুয়েমুছে যায় রোজী আফসারীর নায়িকা হিসেবে পরিচিতি। ছবি: সংগৃহীত

রোজী আফসারী
যে দশকে রোজী আফসারী নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, সে দশকেই চরিত্রাভিনেত্রী বনে যান। ষাটের দশকেই ধুয়েমুছে যায় তাঁর নায়িকা হিসেবে পরিচিতি। যে জন্য এই প্রজন্মের দর্শকেরা তাঁকে মা, বোন, ভাবির বাইরে ভাবতে পারেন না।

রোজীর প্রথম ছবি জিল্লুর রহিমের ‘এই তো জীবন’ (১৯৬৪)। নায়িকা হিসেবেই চিত্রজগতে তাঁর পদার্পণ। এরপর একটানা তিনি ছবি করে যান। যার মধ্যে উর্দু ছবির সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। তখন নায়িকা হিসেবে যথেষ্ট সম্ভাবনার স্বাক্ষর রাখেন রোজী। এ দেশের প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম’–এর (১৯৬৪) নায়িকা রোজী। নায়িকা হয়ে রোজীকে আরও দেখা গেছে ‘বন্ধন’ (১৯৬৪), ‘একালের রূপকথা’ (১৯৬৫), ‘ইস ধরতি পর’ (১৯৬৫), ‘পুনম কি রাত’ (১৯৬৬), ‘উলঝান’ (১৯৬৭), ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’ (১৯৬৭), ‘চোরাবালি’ (১৯৬৮), ‘প্রতিকার’ (১৯৬৯), ‘বেদের মেয়ে’ (১৯৬৯), ‘আলোর পিপাসা’ (১৯৬৯) ছবিতে।

প্রায় ৪ দশক ধরে তিনি ৩৫০টির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয় ছবির মধ্যে রয়েছে ‘লাঠিয়াল’, ‘এতটুকু আশা’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘অশিক্ষিত’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ইত্যাদি। ২০০৭ সালে তিনি মারা যান।

শর্মিলী আহমেদকে ছোট পর্দায় নিয়মিত দেখা গেলেও তিনি আদতে চলচ্চিত্রের মানুষ। ছবি: সংগৃহীত
শর্মিলী আহমেদকে ছোট পর্দায় নিয়মিত দেখা গেলেও তিনি আদতে চলচ্চিত্রের মানুষ। ছবি: সংগৃহীত

শর্মিলী আহমেদ
টেলিভিশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘মা’ বলা চলে শর্মিলী আহমেদকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তিনি মায়ের চরিত্রে সার্থক অভিনয় করে চলেছেন। তাঁর সমসাময়িকেরা ছুটি নিলেও তিনি চুটিয়ে কাজ করছেন। বয়সকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে তিনি অভিনয়ের জগতে এখনো ব্যস্ত। ছোট পর্দায় এখন তাঁকে নিয়মিত দেখা গেলেও তিনি আদতে চলচ্চিত্রের মানুষ। শত চলচ্চিত্রে তাঁকে দেখেছেন দর্শক। সেখানেও চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। অথচ তাঁর শুরুটা হয়েছিল অন্য রকম। নায়িকা হয়েই তাঁর পথচলা শুরু। ষাটের দশকের নায়িকাদের তালিকায় তাঁর নামটিও পাওয়া যায়।
‘তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছ আমার অজান্তে’ এই গানটিকে ছাড়া ষাটের দশকের প্লেব্যাকে-ইতিহাস অসম্পূর্ণ। ছবির ‘সাতটি রংয়ের মাঝে আমি’ গানটিও জনপ্রিয়। এই দুটি গানে পারফর্ম করেছিলেন শর্মিলী আহমেদ। গান দুটি ‘আবির্ভাব’ ছবির। এ ছবিতে শর্মিলী আহমেদেরও আবির্ভাব। ছবিটির পরিচালক সুভাষ দত্ত। ছবিতে শর্মিলীর নায়ক ছিলেন আজিম। ছবির আর একটি জুটি ছিলেন রাজ্জাক ও কবরী। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আলিঙ্গন’ ছবিরও নায়িকা ছিলেন শর্মিলী। এ ছাড়া শর্মিলী অভিনয় করেছিলেন ‘পাঞ্চি বাওরা’ নামের একটি উর্দু ছবির নায়িকা হিসেবেও। এতে তাঁর নায়ক ছিলেন হায়দার শফি।

‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিটি ছিল আনোয়ারার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ছবি: সংগৃহীত
‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিটি ছিল আনোয়ারার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ছবি: সংগৃহীত

আনোয়ারা
অনেকে বলে থাকেন, এ দেশে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে আনোয়ারের মতো খ্যাতি আর কেউ পাননি। মা, বোন, ভাবি, স্ত্রী, প্রেমিকা—এ রকম কত শত ভূমিকায় যে দর্শক তাঁকে দেখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। রেকর্ডসংখ্যক ছবিতে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্তির রেকর্ডও তাঁর দখলে।
আজ তাঁর যেমন প্রভাব, দাপট, যশ, খ্যাতি; শুরুতে কিন্তু তেমন ছিল না। নৃত্যশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল তাঁকে। অনেকগুলো ছবিতে নাচের পর আসে অভিনয়ের সুযোগ। প্রথমে সহ-নায়িকার চরিত্র পান। পরে পূর্ণ নায়িকা হিসেবে দর্শকের চোখে ধরা দেন। ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শিবলী সাদিক ও সৈয়দ আউয়াল পরিচালিত ‘বালা’ নামের একটি উর্দু ছবিতে নায়িকা হন আনোয়ারা। তখন তাঁর নাম ছিল আনোয়ারা জামাল। তাঁর বিপরীতে ছিলেন হায়দার শফি। যিনি সেই সময় উর্দু ছবির নায়ক ছিলেন।
‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিটি ছিল আনোয়ারার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ছবিতে তিনি আলেয়া চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘দেবদাস’, ‘শুভদা’, ‘সুন্দরী’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘রাধা কৃষ্ণ’ ইত্যাদি তাঁর পুরস্কারজয়ী সিনেমা।