এই দোষ দেওয়ার খেলা থামানো উচিত

আনুশেহ আনাদিল। ছবি: সংগৃহীত
আনুশেহ আনাদিল। ছবি: সংগৃহীত

আনুশেহ আনাদিল শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী ও উদ্যোক্তা। আত্ম উপলব্ধি ও পড়াশোনা থেকে তিনি ফিরে গেছেন প্রাকৃতিক জীবনযাপনে। সেই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানালেন করোনাভাইরাস উপদ্রুত এ সময়ে নিজের উপলব্ধির কথা।

করোনায় গৃহবন্দী এ সময়টা আপনার কাছে কেমন?
মানুষ পরিবারকে সময় দিচ্ছে। বাচ্চারা সবচেয়ে খুশি, স্কুলে যেতে হচ্ছে না, পড়ার চাপ নেই। যে মা–বাবারা তাদের একদম সময় দিতেন না, তাঁরা এখন সময় দিতে বাধ্য হচ্ছেন। পারিবারিক বন্ধন, আন্তরিকতা ফিরে আসছে। আমাদের আসলে এসবেই মনোযোগ দেওয়া উচিত।

আপনার বাচ্চারা?
তাদের নিয়ে গল্প, গানবাজনা করছি। আমরা নিয়ম করে একসঙ্গে যোগব্যায়াম ও ধ্যান করি। তারা তো স্কুলে যায় না, আমি বাড়িতে পড়াই। তারা একটু অন্যভাবে বেড়ে উঠছে। তাদের গণিত বা ভাষাজ্ঞানের চেয়ে কীভাবে নিজের যত্ন নিতে হয়, সেই জ্ঞানটা অনেক বেশি। সন্তানদের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান দেওয়া জরুরি। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্কের জ্ঞানটা তাদের দেওয়া দরকার।

আনুশেহ আনাদিল। ছবি: সংগৃহীত
আনুশেহ আনাদিল। ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের জ্ঞানটা বোধ হয় আমরা চর্চা করি না?
হ্যাঁ। প্রতিটি প্রাণী দেখবেন অসুস্থ বোধ করলে প্রকৃতি থেকেই নানা রকম গাছগাছড়া খুঁজে খেয়ে সুস্থ হয়ে যায়। আমরা মানুষেরাও আগে সেটা করতাম। কোনো কোনো গোত্রের মানুষ এখনো করে। এখন আর আমরা সেটা পারি না। কারণ, আমরা অমনোযোগী হয়ে গেছি।

করোনাভাইরাস কি ঘরে আটকে এসবে মন দিতে বলছে?
ঠিক তা–ই। ঘরে অবরুদ্ধ থাকলে অন্তর্গত যাত্রার একটা সুযোগ তৈরি হয়। আমরা বাহ্যিক জীবনের প্রতি এত মোহগ্রস্ত হয়ে গেছি যে এর বাইরেও যে কিছু আছে, সেটা ভুলে গেছি। আমরা সবকিছুকে পণ্য করে ফেলেছি। যদি কেউ ভাবে যে করোনাভাইরাস মানুষের কর্মফল, তাহলে তা–ই। আমরা মানুষেরা এত দিন প্রকৃতির সঙ্গে যে আচরণ করেছি, এখন তার ফল পাচ্ছি।
করোনাভাইরাস কিন্তু আমাদের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি।

মেয়ে রাহার সঙ্গে আনুশেহ। ছবি: সংগৃহীত
মেয়ে রাহার সঙ্গে আনুশেহ। ছবি: সংগৃহীত

কারণ, আমরা ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর চেয়ে অনেক বায়োডায়ভারসিটি–সম্পন্ন, কম স্যানিটাইজড থাকি। আমার বর তো আমেরিকান। সে ঢাকায় আসার পর তিন-চার মাস টয়লেটে কাটিয়েছে। পরে বুঝলাম বেশি স্যানিটাইজড থাকায় তাঁর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গিয়েছিল। আমরা তখন পান্ডুকে সবকিছুর সঙ্গে বেশি বেশি করে মেশাতে লাগলাম। এখন সে সব জায়গায় যায়, সব ধরনের খাবার খায়।

এই ভারসাম্যহীনতায় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার উপায় কী?
দেখুন, যে মানুষগুলোকে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, যার কাছ থেকে আমরা খাবার পাই, সেই কৃষকের কামাই সবচেয়ে কম। আর হলিউড স্টার, ফুটবল খেলোয়াড়দের আয় কত! তাঁদের আমরা আইডল হিসেবে দেখি। যাঁদের মূল্য দেওয়া উচিত, আমরা তাঁদের মূল্য দিচ্ছি না। আমরা গভীরটা দেখি না, দেখি ওপরটা। পৃথিবী একটা ঝাঁকি দিয়েছে আমাদের, যাতে আমরা সত্যে মনোযোগ দিই। সত্য কিন্তু হাজারটা হতে পারে না। সত্য একটাই। মানুষ নিজেই নিজের বাস্তবতা তৈরি করে। এখন চীন দোষ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে, যুক্তরাষ্ট্র দোষ দিচ্ছে চীনকে। আমার মনে হয়, এই দোষ দেওয়ার খেলা থামানো উচিৎ। থামিয়ে এখন সবার উচিত সবাইকে বোঝা। বোঝা দরকার যে আপনি-আমি আলাদা ব্যাপার নই। আমরা কেউ পৃথিবী ও প্রকৃতি থেকে আলাদা নই।

এই সময়টা কীভাবে কাটানো উচিত?
সবাই সবাইকে সময় দিতে হবে, ভাবতে হবে, নিজের ভেতরে অন্তর্যাত্রা করতে হবে। আইসোলেশন আসলে সেটাই। লালন সাঁই, হাসন রাজা—সবাই যে বর্তমানে থাকতে বলেছেন, সে কারণেই। অতীত ও ভবিষ্যৎ রিয়েলিটি নয়, রিয়েলিটি হচ্ছে বর্তমানে থাকা।

নেপালের বন্ধুদের সঙ্গে আনুশেহ। ছবি: সংগৃহীত
নেপালের বন্ধুদের সঙ্গে আনুশেহ। ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাসের ছড়ানোর পর একটি গান লিখেছেন আনুশেহ:

ধরার বচন
আনুশেহ

ধরার গতি যেজন মানে
সবুর সেজন জানে
জগৎ জয়ের মোহ ভেঙে
বহে ধরার টানে

ধরার সাথে গাহে যারা 
মিলন সুরের গায়েন তারা 
ভূবন বুকে সকল প্রাণী 
গাহে ঐক্যতানে

 স্রোতের প্রতিকূলে বেদন 
ধরার বুকে কাঁটা 
ভূবন তুড়ে যেজন গড়ে 
তার জীবনে ভাটা

দেহ আমার জড়িয়ে মা'র ওই  
ধরণীতে ঘেরা 
নদীর উপর বাঁধ তাইতে 
হৃদপিণ্ডে বেড়া

 বৃক্ষ, বারি, পাষাণ, গিরি 
গাইছে যে তার গান 
পণ্য ভেবে তুচ্ছ তাদের    
ছিন্ন সে সম্মান

জলাশয়ে ভরন আর 
মরুকূলে বন 
হিমঘর ভেংগে জল 
গরমিল মন

তারকাটা সীমান্ত রেখা 
লালসার ওই দাগ 
প্লাবন হয়ে মুছবে যদি 
না ভাংতির রাগ

ধরা দাতা, ধরা মাতা  
তবু ধরারেই না মানে 
ও তুই লালন বিনে 
পালন পাবি কেনে?