'ক'-য় কলা, 'খ'-য় খায়

`ডুমুরের ফুল` ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
`ডুমুরের ফুল` ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

তখন পিলসুজে বাতির যুগ। সন্ধ্যাবেলা ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে কুপি জ্বালিয়ে বেরিয়ে পড়তেন জেলেপাড়ার দু-একজন। পাশের গেরস্থ ঘরে টিভি আছে। বিটিভির সিনেমার সময় তখন সন্ধ্যা।

বিটিভিতে আগে সিনেমা দেখানো হতো বিকেলে। মাসে একবার, সেখান থেকে নেমে ১৫ দিনে একবার, এরপর সম্ভবত প্রতি সপ্তাহে, বিকালে। সর্বশেষ স্মরণকাল বলছে, বিটিভি এক সময় কার্যক্রম ‍শুরু করত বিকাল ৫টায়। সেখান থেকে ৩টায়, সিনেমার সময়ও এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঠিক করা হতো।

সেসব দিনের কথা আজ আর সেভাবে মনে নেই। কিন্তু ভাবনা কী! যদি 'হয়তো' 'সম্ভবত'—শব্দগুলো শব্দভাণ্ডার থেকে তো এখনো মুছে যায়নি। এটুকু মনে আছে, তখন সময়টা ছিল এখনকার মতোই। করোনাকাল নয়, মাহে রমজান।

সিনেমা শুরু হতো ইফতারের একটু আগে। যতদূর মনে পড়ে, প্রথম সিনেমাটা ছিল বুলবুল আহমেদ-ববিতার 'ওয়াদা'। সেই ছবিতেই ছিল রুনা লায়লা-খুরশিদ আলমের কণ্ঠে 'যদি বউ সাজো গো, আরও সুন্দর লাগবে' গানটা।'

বিকেল থেকে সন্ধ্যা, এরপর রাতেও সিনেমা দেখিয়েছে বিটিভি। সম্ভবত রাত সাড়ে ৯টায়। সে এক বিশাল হ্যাঁপা। পরীক্ষা-টরীক্ষা না থাকলে রাত ১০টার পর বাড়ির কচিকাঁচাদের জেগে থাকা ছিল 'হারাম'। লেপ মুড়ি দিয়ে দেখতে হয়েছে সে সময় বিটিভির প্রথম রাতের সিনেমা।

নাম মনে নেই, তবে জসিমকে চানাচুর বিক্রি করতে দেখা গেছে। 'চানাচুররররর…'এমন একটা গানও ছিল। স্মৃতি ভুল না করলে পার্শ্বনায়ক গলায় রুমালের গিঁট দেওয়া মাহমুদ কলি। নায়িকাদের মনে পড়ে না। তখন বয়সটাই ছিল নায়িকাদের এড়িয়ে চলার। তবে শয়তানদের খপ্পরে পড়ে 'বাঁচাও বাঁচাও' চিৎকার না করে 'ইয়ায়া ঢিসুম…ঢিসুম' নায়িকা হলে ভিন্ন কথা।

আসলে তখন বিয়েবাড়িতে 'দিদি তেরা দেবর দিওয়ানা' বা 'দিওয়ানা' সিনেমার 'অ্যায়সে দিওনাগি দেখি কাভি নেহি'র যুগ। তাতে সুর মেলালেও চোখ পড়ে থাকত অ্যাকশনে। মানুষের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, মায়া-মমতার বিচিত্র সব অনুভূতি বোঝার মাথা তখনো হয়নি।

`প্রেসিডেন্ট` ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
`প্রেসিডেন্ট` ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

ওদিকে 'টার্মিনেটর' ও পারদের মানুষের পা পড়েছে অজ পাঁড়া-গাঁয়ে। 'ফুল অউর কাঁটে'র অজয় দেবগণকে এক্স-এল হোন্ডায় স্টান্ট দৃশ্য দেখা হচ্ছে প্রায়ই। পায়ের ফ্লাইং কিকে চোখ ধাঁধাচ্ছেন অক্ষয় কুমার। এসবেই পাতা রইত চোখ দুটো। কান দুটো থাকত সজাগ, শুক্রবার বিটিভির অনুষ্ঠানসূচির ঘোষণায়। সিনেমা হল দূর অস্ত, ভিসিপি দেখার সৌভাগ্য হতো কমই। কানের ওপর দু-চার ঘা দেওয়া বড়রা কিন্তু ভিসিপি ভাড়া করেছেন ঘরের চাল চুরি করে বেচে!

এই অনাচারে বিক্ষুব্ধ মনটা রুপালি পর্দার অ্যাকশন হিরোর সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে ফেলেছে কত বার! কিন্তু চাইলেই তো আর অ্যাকশন সিনেমা দেখা যায় না। তাই শুক্রবার কী সিনেমা দেখানো হবে, তা শুনতে হতো।

নামের মধ্যে একটু অ্যাকশন ভাব থাকলেই বেশ। নায়ক-নায়িকা কে বা কারা, তা শোনা্ও জরুরি। 'আজ আপনারা দেখবেন “ফুলশয্যা” সিনেমা। পরিচালক সুভাষ দত্ত। শ্রেষ্ঠাংশে রাজ্জাক, ববিতা…' ব্যস এটুকু শুনেই পরিষ্কার, বিকালটা খেলার মাঠে বিনিয়োগ করাই লাভজনক। যা চাই, যেভাবে চাই, সুভাস দত্ত, রাজ্জাক ও সিনেমার নামে সেসব অনুপস্থিত।

সিনেমার মানুষদের নামগুলো পরিচিত হয়ে ওঠায় শুধু টিভিতে বিজ্ঞাপন, সাময়িকী ও সংবাদপত্রের ভূমিকাই ছিল না। বাড়িতে বিধিনিষেধ আরোপকারীরাই পরোক্ষভাবে উসকে দিতেন। বড়দের আড্ডার পাশে পড়াশোনার ভেক ধরে বসে থাকার এই এক মজা!

নারায়ণ ঘোষ মিতা, খান আতাউর রহমান, ইবনে মিজান, কাজী জহির, আজিজুর রহমান, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম প্রমুখদের নামগুলো তাঁরা কানে তুলে দিতেন। 'সে যে কী হিট-ইর (মূলত দুঃখ-কষ্ট) বই বানাইছে…'—শোনামাত্রই বাতিলের খাতায়। তখন সালমান শাহর সময়। তবে ইবনে মিজান হলে ভিন্ন কথা। তাঁর সিনেমায় ছিল সাপ-খোপ, রাক্ষস আর পাতালপুরীর গল্প। তলোয়ারের ঝনঝন আর নাগ-নাগিনীর ফণা, মন্দ লাগত না। কিন্তু ততদিনে ফটিক, পাগলা দাশু, হাক ফিন, টম সয়্যার পড়ে ফেলায় মনটা ভিন্ন কিছু চাইত। একেবারে নিজস্ব কিছু। পাইয়ে দিল 'দীপু নাম্বার টু'!

ধনী-গরীব বৈষম্য, প্রেম, অ্যাকশন, এসবের বাইরেও যে বাংলা সিনেমা হতে পারে, তা সে প্রজন্ম সম্ভবত প্রথম জেনেছিল 'দীপু নাম্বার টু' দেখে। ছোটদের নিয়েও সিনেমা হয়! দীপু-তারেকের হাত ধরে সে জগতে পা রাখার পর ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল আরও নাম। তখন সময় পেরিয়ে গেছে।

`ছুটির ঘণ্টা` ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
`ছুটির ঘণ্টা` ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

এরিখ কাস্টনারের বই থেকে বাদল রহমান 'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী' বানিয়েছিলেন আগেই। ১৯৮০ সালে। মাস্টার পার্থ নাম ভূমিকায়। 'মুক্ত পাখিকে বন্দী করো না' রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে ঢাকায় আসার পথে ৫০০ টাকা হারায় এমিল। টাকাটা উদ্ধার করা নিয়েই গল্প। আছে রাজাকারের বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণ। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হয়েছিলেন টিপটিপ।

পুর্ণাঙ্গ শিশুতোষ না হলেও শিশু চরিত্রের প্রাধান্য রেখে বানানো হয়েছে 'ডুমুরের ফুল', 'ডানপিটে ছেলে', 'অশিক্ষিত', 'ছুটির ঘণ্টা', 'এতিম', 'মাসুম', 'রামের সুমতি', 'পুরষ্কার'। 'দূরত্ব' ও 'আমার বন্ধু রাশেদ' এল বেশ পরে।

মজার ব্যাপার, সেই সময় বাতিলের খাতায় থাকা পরিচালকেরাই এসব সিনেমার স্রষ্টা। সুভাষ দত্ত ১৯৭৮ সালে বানিয়েছিলেন 'ডুমুরের ফুল'। আশরাফ সিদ্দিকীর 'গলির ধারের ছেলেটি' গল্প অবলম্বনে এক এতিমের চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতেছিলেন মাস্টার শাকিল। ছবিটিতে অভিনয় করতে সুভাস দত্তের কাছে চিঠি লিখেছিলেন শাকিল, 'দাদা, আমার সালাম নেবেন। শুনলাম ডুমুরের ফুল ছবি করছেন। ওতে এক সর্বহারা এতিম বালকের চরিত্র আছে। আমাকে দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ইতি, শাকিল।'

নাম আজাদ রহমান শাকিল হলেও বাংলা সিনেমায় তিনি মাস্টার শাকিল। শিশু চরিত্রে পারঙ্গমতায় অনেকেই তাঁকে তুলনা করতেন 'পথের পাঁচালী'র অপুর সঙ্গে।

লেখক মকবুলা মনজুরের কাহিনি থেকে ১৯৮০ সালে খান আতা বানালেন ডানপিটে ছেলে। এই মকবুলা মনজুর লোককাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্র বানিয়ে খ্যাতি কুড়োনো পরিচালক ইবনে মিজানের বোন। সে যাই হোক, শাকিল এ সিনেমায় 'ডাকু' নামে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর পুরষ্কার জেতেন। ডাকু দুরন্তপনায় তরুণ মজুমদারের 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এর সঙ্গে তুল্য।

ডাকুর মুখে স্কুলের একুশে ফেব্রুয়ারিতে 'ক'-য় কলা, 'খ'-য় খায়, এত বেশি খেতে নাই/'গ'-য় গরু, 'ঘ'-য় ঘাস, কত ঘাস খেতে চাস' গানটি অনেকের মনে থাকার কথা। আবার এই ডাকু যখন বাঁশের ডালে মাছরাঙাকে দেখে বলে 'ওই মাছরাঙা ধরা দিবি? তোর মতো উড়তে পারলে আমিও দেশটারে ঘুইরা ঘুইরা দেখতাম।' যেন বয়ঃসন্ধির খুপরিতে আটকে থাকা এক কিশোরের দীর্ঘশ্বাস। এরপরই খান আতার মেয়ে রুমানা ইসলামের কণ্ঠে ডাকুর ‍মুখে ফোটে সেই গানটি 'হায় রে আমার মন মাতানো দেশ / হায় রে আমার সোনা ফলা মাটি / রুপ দেখে তোর কেন আমার নয়ন ভরে না।'

ছবির ডাকু-তারেক চরিত্র দুটি মন ভরিয়ে দেওয়ার মতো। শ্রেণিবৈষম্য, জলাতঙ্ক রোগ, দুই সহপাঠির জীবনের দু-রকম গন্তব্য নিয়ে গল্পটা ভাবিয়ে তোলার মতো।

`সন অব পাকিস্তান` ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
`সন অব পাকিস্তান` ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

ভাবিয়ে তোলে পুরষ্কারের গল্পও। সৈয়দ শামসুলে হকের কাহিনি থেকে ১৯৮৩ সালে সিনেমাটি বানান সি.বি জামান। কিশোর অপরাধ নিয়ে দেশের প্রথম ছবি। দুই বন্ধু আবার শত্রুও, রতন ও বাদশার ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মাস্টার সুমন ও মাস্টার শাকিল।

কিশোর সংশোধনকেন্দ্রে সুমন-শাকিলের ঠোঁটে 'হার-জিত চিরদিন থাকবেই / তবু এগিয়ে যেতে হবে' গানটির জনপ্রিয়তা এখনো কমেনি। চিত্রনাট্যও মনে গেঁথে থাকার মতো, যে জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরষ্কারও পেয়েছিলেন সব্যসাচী লেখক। শাকিল ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে, কেন্দ্রীয় চরিত্রে সুমন। শাকিল একবার বলেছিলেন 'সুমন চ্যাম্পিয়ন অভিনেতা। 'ছুটির ঘণ্টা' ও 'অশিক্ষিত' ছবির জন্য সুমনকে দর্শক এখনো মনে রেখেছে।' নারায়নগঞ্জে এক স্কুলছাত্রের মর্মান্তিক ‍মৃত্যুর ঘটনা অবলম্বনে 'ছুটির ঘণ্টা'র গল্প বানিয়েছিলেন আজিজুর রহমান।

মাস্টার সুমন ছিলেন সেই খোকন। 'একদিন ছুটি হবে' 'আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী' এ সিনেমার ক্লাসিক গান। সিনেমা যে শুধু বিনোদন নয় জীবনের শিক্ষাও তা টের পাইয়ে দিয়েছিল 'ছুটির ঘণ্টা'। হয়তো একটু বেশিই। দিনাজপুরের এক হলে ছবির আবেগে নিজেকে সঁপে কোলের শিশুসন্তানকে চাপ দিয়ে মেরে ফেলেছিলেন এক নারী।

১৯৮০ সালে 'ছুটির ঘণ্টা' মুক্তির দুই বছর আগে মুক্তি পায় 'অশিক্ষিত'। আজিজুর রহমানের এ ছবিতে গ্রাম্য চৌকিদারকে লেখাপড়া শেখায় অনাথ মানিক। ঘটনাক্রমে সে খুন হয় এবং চৌকিদারের সাক্ষ্যে বিচার হয় অপরাধীর। সাক্ষী হিসেবে চৌকিদারে নাম দস্তখত করার দৃশ্যটি ছিল গোটা সিনেমার মর্মবাণী। মাস্টার সুমন মানিক চরিত্রে অভিনয় করে জিতেছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার। 'মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত' এবং 'ঢাকা শহর আইস্যা আমার পরান জুড়াইছে' এ সিনেমার জনপ্রিয় গান।

মাস্টার শাকিলকে নিয়ে একই বছর 'এতিম' ও পরের বছর মাস্টার সজীবকে নিয়ে 'মাসুম' বানান শেখ নজরুল ইসলাম। ১৯৮৫ সালে শরৎচন্দ্রের গল্প থেকে 'রামের সুমতি' বানান শহীদুল আমিন। শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর পুরষ্কার জিতেছিলেন জয়, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ববিতা।

এরপর ছোটদের নিয়ে সিনেমার আর হলো কোথায়? মুহাম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৯৬ সালে এসে মোরশেদুল ইসলাম বানালেন 'দীপু নাম্বার টু'। ছোটদের সিনেমা বলতে যা দু-একটা, এরপর বেরিয়েছে তাঁর ঝুলি থেকেই।

দীপুর হাত ধরে সেই প্রজন্ম ২০০৪ সালে এসে পেয়েছে 'দূরত্ব', ২০১১-তে 'আমার বন্ধু রাশেদ'। ততদিনে ওরা যুবক, দীপু একা কুলিয়ে উঠতে না পারায় সাহায্য করতে এসেছে বাহির থেকে; 'বেবিজ ডে আউট', 'হোম অ্যালোন', 'ইটি: এক্সট্রাটেরেস্টিয়াল', 'জুমানজি', 'ডেনিস দ্য মিনেস'…অ্যাডভেঞ্চার অব হাক ফিনের।

সত্যি বলতে, প্রজন্মকে টানতে হয়েছে একা দীপুকেই। ১৯৯৬ সালটা এ ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যবাহী। কিছু না হলেও বড়দের দু-একটি সিনেমায় মোটামুটি কাজ চালিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু সে বছর সালমানের মৃত্যুর পর সিনেমা ধীরে ধীরে যে পথে নেমেছিল, তা বোঝাতে একটি উদাহরণেই যথেষ্ট।

`ডানপিটে ছেলে` ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
`ডানপিটে ছেলে` ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

তখন পথে-ঘাটে সিনেমার রঙিন পোস্টার দেখা যেত। প্রধান চরিত্রগুলো ছিল পোস্টারের ফোকাস। পরিবারে সঙ্গে বের হলে কেউ পোস্টারে তাকাত না। জ্যাঠামো, ইঁচড়ে পাকামো আরও যা যা হতে পারে, এসব সহযোগে আড়চোখে তাকিয়ে ভাবতে হতো, কবে বড় হব?

পোস্টার দেখে দেখে একদিন বড় হয়ে যাওয়া। জানা গেল, স্বাধীনতার আগে 'প্রেসিডেন্ট' একমাত্র শিশুতোষ সিনেমা। পরিচালক ছিলেন ফজলুল হক, পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক মাসিক সাময়িকীর সম্পাদক ফজলুল হক। গল্প তাঁর সহধর্মিনী কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের 'দুঃসাহসিক অভিযান'-এর। অভিনয় করেছিলেন তাঁদেরই সন্তান মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর ও রন্ধনবিদ কেকা ফেরদৌসী। রোমাঞ্চকর কাহিনির এই সিনেমা সেন্সর জটিলতায় পরে 'সন অব পাকিস্তান' নামকরণ করা হয়। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লোত্তে হোয়েক তাঁর 'ক্রস-উইং ফিল্মমেকিং: ইস্ট পাকিস্তানি উর্দু ফিল্মস অ্যান্ড দেয়ার ট্রেসেস ইন দ্য বাংলাদেশি ফিল্ম আর্কাইভ' প্রবন্ধে লিখেছেন এ নিয়ে।

ফরিদুর রেজা সাগর এবং ফজলুল হকের ছোট ভাই ড. ফজলুল আলমের সঙ্গে কথা বলে লোত্তে পরিষ্কার হতে পারেননি কোন ভাষায় বানানো হয়েছিল এ সিনেমা। শুটিংয়ের সময় ফরিদুর রেজা সাগরের বয়স মাত্র ১০ বছর। কথপোকথনে সেভাবে স্মরণ করতে পারেননি, 'গল্পের প্রয়োজনে 'করাচি, লাহোর, রা্ওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ, পেশোয়ার, সোয়াতে যেতে হয়েছিল'। ছবিতে অনেক উর্দু সংলাপ ছিল। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে তারা বাংলায় কথা বলেনি। তবে সিনেমাটা ছিল বাংলায়। পরে সিনেমাটা দেখেছেন এমন ‍দুজনের সঙ্গেও কথা বলেন লোত্তে। এদের একজন ঢাকার এক পরিচালক। চট্টগ্রামের এক হলে 'সন অব পাকিস্তান' দেখেছিলেন তিনি এবং নিঃসংকোচে জানান সিনেমাটি ছিল 'উর্দু ভাষায়'। লোত্তেকে তাঁর এক সহকর্মী জানান, ঢাকায় মায়ের সঙ্গে তিনি সিনেমাটি দেখেছিলেন 'কারণ সেটি ছিল ইংরেজিতে শিশুতোষ সিনেমা।' বেচারি লোত্তে!

সেই সহকর্মী তখনকার জনপ্রিয় ট্যাবলয়েড 'ইস্টার্ন সিনেমা'র কিছু পুরোনো সংখ্যা দেন লোত্তেকে। সেসব খুঁড়ে ১৯৬৪ সালের এক সংখ্যায় ফরিদুর রেজা সাগরের একটি ছাপানো চিঠি বের করেন লোত্তে। দর্শকদের প্রতি ইংরেজিতে ফরিদুর রেজা সাগর লিখেছেন, 'প্রেসিডেন্ট খুব দ্রুতই মুক্তি পাবে এবং তা ইংরেজি ও উর্দুতেও।

লাহোরে শাহনূর স্টুডিওতে 'সন অব পাকিস্তান'-এর রিলের খোঁজ নিয়েছেন ফরিদুর রেজা সাগর। নেই। যেমন নেই তাঁর বাবাও, ১৯৭০-৭১ সালের দিকে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর আর ফেরেননি স্বাধীন দেশে। লোত্তে তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, সিনেমা বানাতে ভারতে থেকে গিয়ে 'রহস্যজনকভাবে মারা যান' প্রথম শিশুতোষ সিনেমার এই পরিচালক।

'সন অব পাকিস্তান' ছবির রিল আর পাওয়া যায়নি। তবে ইউটিউবে ডাকু, খোকন, মানিক, রতনদের গল্প আছে। কাঁটছাট করা সেসব সিনেমা দেখেও মনে হয় বড় হওয়াটা ভুল। আর এই ভুলই যদি হবে তবে যে বয়সে দেখার কথা ছিল, সে সময় ছিলে কোথায়!