রবীন্দ্রনাথ ও চলচ্চিত্র

এখনো নানাভাবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতিতে প্রাসঙ্গিক। ছবি: সংগৃহীত
এখনো নানাভাবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতিতে প্রাসঙ্গিক। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ আমাদের রেনেসাঁমানব। বহু বৈচিত্র্যময় পথে তাঁর অবাধ যাতায়াত। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৫৯ বছর আগে তিনি এসেছিলেন এ জগতে। এখনো নানাভাবে তিনি আমাদের সংস্কৃতিতে প্রাসঙ্গিক। তাঁর বিশাল সৃষ্টি–সাম্রাজ্য থেকে শুধু পারফর্মিং আর্টের একটা অংশ নিয়ে আমরা আজ কথা বলব এখানে।

রবীন্দ্রনাথ চলচ্চিত্র নিয়ে কতটা ভেবেছিলেন? গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে তাঁর বিভিন্ন লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, অক্ষর দিয়ে সাজানো সাহিত্যের প্রতি তিনি তখন খুব একটা আকর্ষণ বোধ করছিলেন না! চিঠিপত্রে ঘনিষ্ঠজনদের জানাচ্ছিলেন, বাক্যসৃষ্টির ব্যাপারে তাঁর সংশয়ের কথা। আর সে পথ ধরেই এক নতুন নির্মাণরীতির জন্ম হলো তাঁর লেখায়। ১৯৩৪ সালে লেখা তাঁর ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসটি খুলে দেখুন। চারটি অধ্যায় যেভাবে শুরু হচ্ছে, তাকে অনায়াসে কোনো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য হিসেবে ভাবা যেতে পারে।

‘চোখের বালি’ ছবিটি ভারতের জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
‘চোখের বালি’ ছবিটি ভারতের জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

আমরা জানি, ১৯২৯ সালে শিশির ভাদুড়ির পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি ‘বিচারক’ ছবিটি তখন রয়েছে আলোচনায়। মুরারি ভাদুড়িকে লেখা রবীন্দ্রনাথের সে সময়ের একটি চিঠিতে চলচ্চিত্র নিয়েই ছিল মূল আলোচনা। এ সময় তাঁর ‘তপতী’ নিয়ে ছবি করার কথাও ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩০ সালে জার্মানির মিউনিখে বসে লিখে ফেলেছিলেন একটি চিত্রনাট্য—‘দ্য চাইল্ড’ নামে। ‘শিশুতীর্থ’ নামে তাঁর অনবদ্য কবিতাটিও সেই কাহিনি ধরেই লেখা হয়েছে। ‘শিশুতীর্থ’টাও বের করে পড়ে নিতে পারেন। ৪ সংখ্যক অংশটি দেখলে বুঝবেন, এ–ও এক অসাধারণ চিত্রনাট্য।

এ বছরই তিনি মস্কোয় গিয়ে সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’ ছবিটি দেখেছিলেন। ১৯৩২ সালে তিনি নিজের নাটক ‘নটীর পূজা’র চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছিলেন। মাত্র চার দিনে এ ছবির দৃশ্যায়ন সম্পন্ন হয়েছিল। তিনি স্বয়ং উপালি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আর ছিল শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীরা। এ থেকে বোঝা যায়, চলচ্চিত্র নিয়ে একটা ভাবনা কাজ করছিল রবীন্দ্রনাথের মাথায়। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন গদ্য, পদ্য লেখার জন্য যা খুব বেশি দরকারি নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে তা খুব জরুরি—অর্থ। এই কারণেই হয়তো এ পথে রবীন্দ্রনাথ নিজে আর বেশিদূর হাঁটতে পারেননি। চলচ্চিত্রের জন্য অর্থ লগ্নি করা না হলে ওই ‘সম্মিলিত শিল্প’টি নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব।

রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের কথা বললে সত্যজিৎ রায়ের কথাই মনে ভেসে আসে প্রথমে। তাঁর ‘তিন কন্যা’ (পোস্টমাস্টার, মনিহারা, সমাপ্তি), ‘চারুলতা’ আর ‘ঘরে বাইরে’ দেখার অভিজ্ঞতা যাঁর আছে, তিনি জানেন রবীন্দ্রনাথকে নিজের মতো করেই বুঝতেন সত্যজিৎ। লক্ষ করার মতো ব্যাপার, অন্য অনেক বাঙালির মতো সত্যজিৎ রায়ের বসার ঘরে রবীন্দ্রনাথের কোনো ছবি ছিল না। রবীন্দ্রনাথের কাজে ডুব না দিয়ে তাঁকে দেবতা বানানোর যে উদ্যোগ দেখা যাচ্ছিল চারপাশে, তার বাইরে ছিলেন সত্যজিৎ। তারেক মাসুদ তা নিয়ে এক লেখায় তুলেছিলেন অ্যান্ড্রু রবিনসনের লেখা ‘দি ইনার আই’–এর প্রসঙ্গ। যেখানে সত্যজিতের দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি নেই দেখে অ্যান্ড্রুর প্রশ্নের জবাবে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘সাচ আ ক্লিশে’!

রবীন্দ্রনাথকে নিজের মতো করেই বুঝতেন সত্যজিৎ। ছবি: সংগৃহীত
রবীন্দ্রনাথকে নিজের মতো করেই বুঝতেন সত্যজিৎ। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাহিনি সত্যজিৎ তুলে আনেন পরম নিষ্ঠায়, নিজের মতো করে। এই পাঁচটি কাহিনি চিত্র দর্শকের নান্দনিক খোরাক মেটায়। সত্যজিতের রতন, মৃন্ময়ী, চারু, বিমলারা পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথের রতন, মৃন্ময়ী, চারু, বিমলার মতো নয়। চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি আর সত্যজিতের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও দেখিয়ে দেন কেউ কেউ। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু সেই আলোচনা ছবিগুলো উপভোগ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ালেই হয়। আর হ্যাঁ, রবী ঠাকুর কি এখনো ‘ক্লিশে’ হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় প্রতিবছর তাঁর রচনা থেকে তৈরি চলচ্চিত্র, নাটকের সংখ্যা দেখে।

ঋতুপর্ণ ঘোষ রবীন্দ্রনাথের ছবি করেছেন। ‘চোখের বালি’ আর ‘নৌকাডুবি’। ‘চোখের বালি’ ছবিটি তো ভারতের জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। সে ছবিতে ঐশ্বরিয়া রাই ও রাইমা সেন অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। অল্প বয়সে বিধবা নারীদের মর্মযাতনা তুলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ঋতু সে পথেই চলেছেন। ঋতুপর্ণের আগে ‘নৌকাডুবি’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন নরেশ মিত্র, ১৯৩৮ সালে। সে ছবিটি ছিল নির্বাক।

বহু আগে তপন সিংহ নির্মাণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলীওয়ালা’। সে চলচ্চিত্রে রহমতরূপী ছবি বিশ্বাসের অভিনয় মন ছুঁয়ে গিয়েছিল দর্শকদের।

বাংলাদেশে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে ‘শাস্তি’ ও ‘সুভা’। দুটি ছবিই দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। বিশেষ করে ‘সুভা’ ছবিতে পূর্ণিমার অভিনয় মন কেড়ে নিয়েছিল চলচ্চিত্র দর্শকদের।

সুভা ছবিতে পূর্ণিমার অভিনয় মন কেড়ে নিয়েছিল চলচ্চিত্র দর্শকদের। ছবি: সংগৃহীত
সুভা ছবিতে পূর্ণিমার অভিনয় মন কেড়ে নিয়েছিল চলচ্চিত্র দর্শকদের। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মঞ্চে ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলোর অভিনয় হয়েছে অনেক। শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, ‘রক্তকরবী’ করেছেন। ঢাকার মঞ্চে নাগরিক এনেছে তাঁর ‘রক্তকরবী’, ‘অচলায়তন’; থিয়েটার এনেছে ‘দুই বোন’।

এই ছোট্ট আলোচনা আমরা শেষ করতে পারি বাংলাদেশ টেলিভিশনে মুস্তাফা মনোয়ার নির্দেশিত ‘রক্তকরবী’ (https://www.youtube.com/watch?v=-RfIR7SMcMI) নাটকটির কথা বলে। বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের এক অতি উচ্চ নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় এই নাটকটিতে। নন্দিনী চরিত্রে দিলশাদ খানম, রাজা চরিত্রে গোলাম মুস্তাফার অভিনয় এখনো চোখে লেগে আছে। মোহাম্মদ জাকারিয়া, আনোয়ার হোসেন, হাসান ইমাম, জামালউদ্দিন হোসেন, লায়লা হাসানসহ যাঁরা এ নাটকে অভিনয় করেছেন, তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন, অভিনয় কাকে বলে। এখন কিন্তু এ নাটকটি ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। চাইলেই দেখে নেওয়া যায়।