আর কুলায়া উঠতে পারছি না দাদু

বাউল সুকুমার বৈরাগী। ছবি সংগৃহীত।
বাউল সুকুমার বৈরাগী। ছবি সংগৃহীত।

‘বলব না গো আর কোনো দিন, ভালোবাসো তুমি মোরে’ গানটি অনলাইনে প্রকাশ হওয়ার পর রাতারাতি জনপ্রিয়তা পান শিল্পী সুকুমার মহন্ত। গ্রামে তিনি বাউল সুকুমার বৈরাগী নামে অধিক পরিচিত হলেও দেশের মানুষের কাছে তিনি সুকুমার বাউল নামেই পরিচিতি পেতে শুরু করেন। গানটি একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রায় পাঁচ কোটিবার দেখা হয়েছে। এই বাউল শিল্পীর সঙ্গে গতকাল ৮ মে বিকেলের দিকে কথা হলে জানা যায়, বর্তমান করোনার এই পরিস্থিতিতে আর্থিক সংকটে পরিবার–পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

করোনাভাইরাসর আক্রান্ত না হলেও পরিস্থিতির মারাত্মক প্রভাব পড়েছে সুকুমার বাউলের পরিবারের ওপর। এখন দিন গুনছেন কবে এই করোনাকাল শেষ হবে। আবার গানে না ফিরলে পরিবার নিয়ে তাঁকে বেঁচে থাকতেই সংগ্রাম করতে হবে। বাউল সুকুমার বৈরাগীকে প্রথম প্রশ্ন করি, এই করোনার সময়েও জানতে চাইছি কেমন আছেন আপনি? শুনেই এই বাউল বলেন, ‘আমি ভালো নেই দাদু। সাত দিন হলো খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। কাউকে বলতেও পারছি না। ঘরে অল্প কিছু চাল, ডাল আছে, এখন তরিতরকারি, নুন, তেল, মাছ কেনার সামর্থ্য নেই। খুবই কষ্টে আছি দাদু। করোনার এই দুর্দিনে পরিবারের আটজন সদস্য নিয়ে খেয়ে–পরে বেঁচে থাকতে হিমশিম খাচ্ছি।’

তাঁর সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, আজ ৫১তম দিন বাড়িতে আছেন তিনি। সর্বশেষ এনটিভির একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। তারপর থেকে বেকার বসে আছেন। তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকজন সহায়তা করেছিল, সেগুলো দিয়ে ডাল–ভাত যা–ই হোক খেয়ে এত দিন চলতেছিলাম। এই সপ্তাহখানেক হলো আর কুলায়া উঠতে পারছি না দাদু। পরিবার নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। একমাত্র আমার আয়েই পরিবার চলে। এখন কাজ নাই, কেউ ডাকে না। আয় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। চিন্তায় চিন্তায় দিন যাচ্ছে।’

বগুড়া জেলার সোনাতলা উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকেন বাউল সুকুমার বৈরাগী। তাঁর জন্ম ১৯৫৬ সালে বৈরাগী বৈষ্ণব পরিবারে। বাল্যকালে পরিবার থেকে গানের চর্চার শুরু। তাঁর দাদা প্রভু বৈরাগীর সঙ্গে গ্রামে গ্রামে গান করতেন। দাদার সঙ্গেই গ্রামে বিভিন্ন জায়গায় গান শুনতে যেতেন। এভাবে গানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্ম নেয়। তিনি জানান, ‘প্রথমে দাদুর কাছেই গান শিখি। পরে দাদুর সঙ্গেই বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গান গাওয়া শুরু করলাম। গরিব ছিলাম, এ জন্য পড়াশোনা সেভাবে করতে পারি নাই। সারা দিন গান নিয়েই থাকতাম। ১৯৭১ সালের গন্ডগোলের পর থেকে গ্রামগঞ্জে গান গেয়েছি। ভারতের রাস্তায় রাস্তায় গান করেছি, বাউলদের সঙ্গে কাটিয়েছি। পরে যখন সংসারী হয়েছি, তখন গান গেয়ে যা পেতাম তাই দিয়ে পরিবার চালিয়েছি। গান আমার সবকিছু।’

সুকুমার বাউল আরও বলেন, ‘করোনা এভাবে জীবনকে থামিয়া দিবে, সেটা নিজেও বুঝতে পারিনি। আমি কখনো কারও কাছে হাত পাতিনি। এটা আমাদের বাউলদের সঙ্গে যায় না। কিন্তু এখন আর পারছি না। সময় ভালো হলে তো গান গেয়ে কোনো একভাবে চলতে পারতাম। এখন সেই উপায়ও নেই। বেশ কয়েকজন সাহায্য করেছেন, সেটাও শেষ। এখন হাতে গোনা যে দু–চারজন সাহায্য করে, তাদের কাছে কতবার চাওয়া যায় দাদু বলেন?’

বাউল সুকুমার বৈরাগী। ছবি সংগৃহীত।
বাউল সুকুমার বৈরাগী। ছবি সংগৃহীত।

গত বছর ৩১ মে ইউটিউব চ্যানেল ঈগল মিউজিক থেকে মুক্তি পায় তাঁর গাওয়া গান, ‘বলব না গো আর কোনো দিন ভালোবাসো তুমি মোরে।’ এই গান দিয়েই তিনি সংগীতাঙ্গনে বেশ পরিচিতি পাওয়া শুরু করেন। গানটি তাঁকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। সেটা বোঝা যায় এই গানে প্রায় ২২ হাজার ভক্তের মতামত জমা পড়ে। সেখানে বেশির ভাগ ভক্তই এই বাউলের গানের প্রশংসা করেছেন। এই দুর্দিনে ঈগল মিউজিক থেকেও কিছু সহায়তা পাওয়ার কথা জানালেন তিনি। সে অর্থও শেষ। বাউলকে প্রশ্ন করি, আপনার এই গান অনেক জনপ্রিয়। কেমন লাগে? তিনি বলেন, ‘আমার গান অনেক মানুষ ভালোবাসে। রাস্তায় দেখলে জড়িয়ে ধরে। বাইরে গেলে দূর থেকে মানুষ ছুটে আসে, ছবি তোলে। ভক্তদের এগুলো আমার ভালোই লাগে। সবাই বলে আপনি খুব ভালো গান করেন। তখন আমি বলি, গান ছাড়া আর কিছু যে পারি না।’

সুকুমার বৈরাগী জানালেন, শিল্পকলা একাডেমি, টিএমএসএসসহ বেশকিছু জায়গা থেকে গানের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সেগুলো গ্রামের বাড়িতে যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। সহজ–সরল এই বাউল বললেন, ‘একদিন এসে আমার পুরস্কারগুলো দেখে যাবেন।’ তিনি জানান, ‘আমার ছয় সদস্যের একটা বাউল দল আছে। এঁরা ঢোল, তবলা, বাঁশি, খঞ্জনি, সারিন্দা বাজান। আগে কেউ ফোন দিলে দল নিয়ে ছুটে যাইতাম। এই গান দিয়েই চলে আমার সংসার। করোনা আমার ক্ষতি করে দিল। ক্যামনে পরিবার নিয়ে দিন পার করমু কিছুই বুঝতেছি না। চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে গেলাম দাদু।’