যে সিনেমায় নারীরা নিজেকে খুঁজে পান

সমাজে নারীর যেমন ‘টিপিক্যাল’ একটা ‘ইমেজ’ আছে, চলচ্চিত্রেও তাই। তবে এর বাইরে কিছু সিনেমায় নারীকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে দেখা যায়; যা দর্শক হিসেবে নারীর মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করতে পারে, নিজেকে নিয়ে ভাবনার খোরাক জোগাতে পারে। কলকাতার পরিচালকদের তৈরি এমন তিনটি সিনেমা নিয়েই আজকের লেখা।

‘তুমি কিছুই পারো না, তোমাকে দিয়ে হবে না, তোমার বোনকে/ভাইকে/বন্ধুকে দেখো, ও কত ভালো পারে, তুমি জীবনে কী করবে, বিয়ে করে পরের ঘরেই তো যেতে হবে’—এমন ছোট ছোট অসংখ্য বাক্যবাণে একটু একটু করে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে নিজের কাছে ক্ষুদ্রতর মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠা নারী আমাদের সমাজে অসংখ্য। এমনই দ্বিধান্বিত, নিজের খোলসের মধ্যে আটকে যাওয়া, আত্মপ্রত্যয়হীন টুকুর গল্প নিয়ে নবাগত পরিচালক শিলাদিত্যের চলচ্চিত্র ‘সোয়েটার’।

নির্গুণ টুকু একের পর এক পাত্রপক্ষের কাছে ‘রিজেক্টেড’ হতে থাকে। কেবল এক পাত্রের মা সোয়েটার বুনতে পারার শর্ত দেন। আশাহত মা–বাবা টুকু সোয়েটার বুনতে শেখার অপমানজনক শর্তটাকেই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরে।
দার্জিলিংয়ে উলবোনা শিখতে টুকুর ভরসা পিসি। কিন্তু তাঁর কাছে এসে বদলে যেতে শুরু করে টুকুর জীবন। একটু একটু করে আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে টুকুর মনে। টুকুর কাছে জীবনের অর্থগুলো বদলে দিতে যে কথাগুচ্ছ ছুড়ে দিয়েছেন পিসি, তা দর্শককেও প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাবে।

শক্তিশালী গল্প, নিপুণ অভিনয়, চিত্রগ্রহণ আর হৃদয়-ছুঁয়ে যাওয়া সংগীতে পুরো সিনেমা আটকে রাখে দর্শককে। এই সিনেমার ‘প্রেমে পড়া বারণ’ গানটির জনপ্রিয়তাই এর প্রমাণ মেলে।
বাংলা নাটক কিংবা সিনেমার সবচেয়ে উপজীব্য বিষয় বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক। বিষয়টি নিয়েই পরিচালক পৃথা চক্রবর্তী নির্মাণ করেছেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখার্জীদার বউ’। তবে বউ-শাশুড়ির যুদ্ধের মতো বহুল ব্যবহৃত বিষয়ের ওপর ভিন্ন দিক থেকে আলো ফেলেছেন পরিচালক। যেখানে বউ বা শাশুড়ি নয়, নারী হিসেবে নিজেদের বঞ্চনার গল্পটা আবিষ্কার করতে পারেন তাঁরা।
শাশুড়িকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে নিজের অবস্থান এবং শাশুড়ির অবস্থানকে একই সমান্তরালে খুঁজে পায় পুত্রবধূ। সমাজের কাছে মুখার্জীদার বউ হিসেবে পরিচিতি শাশুড়ি শোভা রানীর চরিত্রে অনসূয়া মজুমদার, পুত্রবধূ অদিতির চরিত্রে কনীনিকা ব্যানার্জি, মনোবিদ ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত নারীর অন্য এক জীবন যেন উপস্থাপন করেছেন।
পরিচালক অপর্ণা সেনের চোখে অনন্য অনেক নারীকেই খুঁজে পেয়েছে বাংলা চলচ্চিত্র। একজন কিশোরী বিধবার এক বাক্স গয়নাকে কেন্দ্র করে নারীর মনের অনেক না-বলা কথাকে প্রকাশ্যে তুলে ধরেছেন গুণী এই পরিচালক। ভৌতিক-রহস্যময়-রসাত্মক ঢঙে ‘গয়নার বাক্সে’র গল্প দর্শককে আনন্দ দেয়।
পিসি রাসমণি (মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়) মারা যাওয়ার পর তার ভৌতিক সাহচার্যে বাড়ির ছোট বউ সোমলতা (কঙ্কণা সেন শর্মা) পরিবারের আর্থিক চিত্রটা আমূল বদলে ফেলে। নিজের আত্মবিশ্বাস আর বুদ্ধির জোরে হয়ে ওঠে পরিবারের প্রধান। রাসমণি আর সোমলতার কথোপকথনে উঠে আসে বাংলার নারীদের চিরন্তন বঞ্চনার অনেক চিত্র। ছবিটি সমাজের প্রথাভাঙার গল্প বলে। নিপুণ অভিনয়, শক্তিশালী গল্প, পরিপাটি নির্মাণ—সব মিলিয়ে অনন্য চলচ্চিত্র ‘গয়নার বাক্স’।