এখনো রাতে ভাত খান না রোজিনা

চিত্রনায়িকা নায়িকা রোজিনা। ছবি: সংগৃহীত
চিত্রনায়িকা নায়িকা রোজিনা। ছবি: সংগৃহীত

রোজিনা এখন মূলত লন্ডনে থাকেন। সেই ১৯৯৫ সাল থেকে…বছরে কয়েক মাসের জন্য আসেন বাংলাদেশে, আবার চলে যান। দেশে বেড়াতে এলে চলচ্চিত্রের কিছু ঘরোয় আয়োজনে দেখা যায় তাঁকে। গত বছরও এসেছিলেন। গোয়ালন্দে নানাবাড়িতে তাঁর উদ্যোগে মসজিদ তৈরি হচ্ছে বলে ফিরে আর যাওয়া হয়নি। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে লন্ডনে ফেরার পরিকল্পনা।

 ঢাকায় উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১৯ নম্বর রোডে রোজিনার বাড়ি। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন সন্ধ্যা। তিনি সাইক্লিং করছিলেন। কথায় কথায় জানালেন, ফিটনেসের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। সুস্থ থাকতে চান বলেই নিয়মিত ব্যায়াম করেন। ‘তিন দশক ধরে নিয়মিত ব্যায়াম করছি। খাবারের ব্যাপারেও বেশ সচেতন আমি। চলচ্চিত্রে আসার পর থেকে রাতে ভাত ছুঁই না’, বলছিলেন রোজিনা।

সব ধরনের ছবিতেই তিনি সাবলীলভাবে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন দর্শকদের। ছবি: প্রথম আলো
সব ধরনের ছবিতেই তিনি সাবলীলভাবে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন দর্শকদের। ছবি: প্রথম আলো

গত ২১ মার্চ চ্যানেল আইয়ের একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে লকডাউনে। এর মধ্যে শুধু দুদিন বাজার করতে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। সময় বেশ ভালোই কাটছে। ঘরে অনেক ধরনের কাজ থাকে, সেগুলো করার পাশাপাশি দুই ঘণ্টা ট্রেডমিল ও সাইক্লিং করেন তিনি। আর এক ঘণ্টা ইয়োগা। তিনি বলেন, ‘ইউকেতে জিমেই দুই ঘণ্টা কাটাতাম। এখন তো সম্ভব না, তাই ঘরেই সব করছি।’

রোজিনা বা রওশন আরা রেনু রাজবাড়ীর মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই সিনেমার পোকা ঢুকেছিল মাথায়। রিকশার পেছনে শাবানা-কবরীর ছবি দেখলেই পিছু নিতেন। রোজিনা বলেন, ‘আমাদের বাড়িটা ছিল রাজবাড়ী রেলস্টেশনের পাশে। রিকশার পেছনে শাবানা-কবরী ম্যাডামদের পোস্টার দেখতাম, মাইকে শুনতাম, “আসিতেছে”, ওটার পেছনে দৌড়াতাম। আবার মাইকে কোনো গান বাজতে শুনলে স্কুলব্যাগ রেখে দৌড় দিতাম পিছু পিছু। এসবের জন্য মায়ের কাছে, পণ্ডিতের কাছে কত যে মার খেয়েছি। কিন্তু আমার মাথায় শুধু এটাই ছিল, শাবানা-কবরীর মতো হতেই হবে।’

রোজিনাদের বাড়ির পাশেই ছিল চিত্রা সিনেমা হল। সেখানে কত ছবি যে দেখেছেন তিনি, সে হিসাব তাঁর কাছে নেই। সিনেমার পোকা এসএসসি পাস করতে দেয়নি রোজিনাকে। তার আগেই নায়িকা হয়ে যান তিনি। ১৯৭৭ সালে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন। ছবির নাম ‘জানোয়ার’। কালিদাশ পরিচালিত এই ছবিতে তিনি ছিলেন অন্যতম নায়িকা। তখনো অবশ্য তিনি রেনু। পরের বছর এ জে মিন্টু সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিলেন ‘মিন্টু আমার নাম’ ছবিতে নায়িকা হচ্ছেন রোজিনা। পরিচালক মহিউদ্দিন রেনুকে রোজিনা বানিয়ে দিলেন। ছবির জন্য দুই মাস মহড়াও হলো। কিন্তু রোজিনা পরে জানলেন, ছবিটায় তিনি নেই। রোজিনা বলেন, ‘ছবির গল্পে নায়িকার নাম ছিল রোজিনা। পাকিস্তানের একজন সুপারস্টারের নাম ছিল রোজিনা। তাঁর নামেই আমার নাম হয়। কিন্তু ছবিটায় আমার আর অভিনয় করা হয়নি। তত দিনে রোজিনা নামটি চলচ্চিত্রের সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।’

রোজিনা বা রওশন আরা রেনু রাজবাড়ীর মেয়ে। ছবি: সংগৃহীত
রোজিনা বা রওশন আরা রেনু রাজবাড়ীর মেয়ে। ছবি: সংগৃহীত

একক নায়িকা হিসেবে রোজিনার সুযোগ আসে এফ কবির পরিচালিত ‘রাজমহল’ সিনেমায়। মুক্তির পর সিনেমাটি সুপারহিট। তারপর একের পর এক ব্যবসাসফল ছবি। যে শাবানা ও কবরীকে দেখে নায়িকা হতে চেয়েছিলেন তিনি, তাঁদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করতে শুরু করেন রোজিনা। তিনিও হয়ে ওঠেন ঢালিউডের একজন বড় তারকা।

গ্রামীণ বা শহুরে নারীর চরিত্র কিংবা সামাজিক অ্যাকশন, সব ধরনের ছবিতেই তিনি সাবলীলভাবে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। রোজিনা অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য সিনেমা হচ্ছে ‘চোখের মণি’, ‘সুখের সংসার’, ‘সাহেব’, ‘তাসের ঘর’, ‘হিসাব চাই’, ‘বন্ধু আমার’, ‘কসাই’, ‘জীবনধারা’, ‘মানসী’, ‘দোলনা’, ‘দিনকাল’, ‘রসের বাইদানী’, ‘জীবনধারা’, ‘রূপবান’, ‘হামসে হ্যায় জামানা’। তাঁর অভিনয় করা ছবি প্রায় দুই শতাধিক। আমজাদ হোসেনের ‘কসাই’ আর মতিন রহমানের ‘জীবন ধারা’ ছবিতে অভিনয় করে দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন রোজিনা। ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানে ‘হাম তো হায় জামানা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পাকিস্তানের ‘নিগার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন।

১৯৭৭ সালে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭৭ সালে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের জনপ্রিয় নায়ক মিঠুন চক্রবর্তী, পাকিস্তানের নাদিমের সঙ্গেও অভিনয় করেছেন রোজিনা। অভিনয়ের জন্য ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের ১০টিরও বেশি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। অভিনয় করতে করতে একসময় অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অনুভব করেন, এবার নিজেকে সময় দেওয়া দরকার। ১৯৯২ সালে ঘোষণা দেন, চলচ্চিত্রে আর নয়। হাতে থাকা ছবিগুলোর কাজ শেষ করতে করতে ১৯৯৪ সাল পার হয়ে যায়। পরের বছর তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। দীর্ঘ বিরতির পর রোজিনা চলচ্চিত্রে ফেরেন ‘রাক্ষুসী’ দিয়ে। রোজিনা বলেন, ‘ইচ্ছা করেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। কাজ করতে করতে মনে হলো, নিজেকে সময় দেওয়া দরকার। আর কিছুই না। তাই ঘোষণা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।’