সবকিছু ভোগবাদী মানসিকতার হয়ে গেছে

তারিক আনাম খান। ছবি: প্রথম আলো
তারিক আনাম খান। ছবি: প্রথম আলো
>করোনার এই স্বেচ্ছাগৃহবন্দী সময়টায় মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী এবং পরিচালক তারিক আনাম খান কী করছেন। বিনোদন অঙ্গন নিয়ে কী ভাবছেন—এসব জানতেই বুধবার দুপুরে কথা হয় তাঁর সঙ্গে

করোনার এই সময়টায় কী করে কাটছে...
পরিবারকে সময় দিচ্ছি। ছবি দেখছি, বই পড়া হচ্ছে। আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের খবর নিচ্ছি।

ঠিক এই সময়টায় করোনা নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী?
প্রকৃতির সঙ্গে আমরা উল্টাপাল্টা আচরণ করেছি, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এর আগেও নানা ধরনের ভাইরাস পৃথিবীতে এসেছে, মহামারি হয়ে অনেকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এর পরও যে শিক্ষাটা গ্রহণ করা উচিত, তা আমরা কখনোই গ্রহণ করিনি। আমাদের উচিত, লোভের বশবর্তী হয়ে ভোগের পেছনে ছোটার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা করা।

সেটা কেমন?
আমরা প্রায়ই টিভি ও পত্রিকায় দেখি, ফ্রিজ কিনবেন? টেলিভিশন কিনবেন? বাড়ি কিনবেন? জমি কিনবেন? এত এত কিস্তিতে নিতে পারবেন। সবকিছু ভোগের বস্তু। আমরা কেউই দেখিনি, আপনার এলাকায় একটা লাইব্রেরি করবেন? স্কুল প্রতিষ্ঠা করবেন—আমরা লোন দেব বিনা সুদে, এমন কথা কেউই বলছি না। মানুষ এত বেশি ভোগের পেছনে ছুটেছে, অন্য কিছু নিয়ে ভাবেনি। ভোগ করে যে টেকা যায় না, তা করোনা প্রমাণ করে দিল।

তারিক আনাম খান। ছবি: সংগৃহীত
তারিক আনাম খান। ছবি: সংগৃহীত

এই যে উপলব্ধি হচ্ছে, এটা কি মানুষ লম্বা সময় নিজেদের মধ্যে লালন করতে পারবে?
আমার তো মনে হয় না। যদি ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়, তার কিছুদিন পর এমনিতে মানুষ ভুলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষজনকে বলতে দেখছি, লকডাউন তুলে দাও। এই লকডাউন ফ্রিডমের ওপরে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। আমরা ফাস্ট ফুডের দোকানে এই খেতে চাই, ওই খেতে চাই। অথচ জীবনটাকে সুন্দর করে কীভাবে বাঁচাব, অন্যকে কীভাবে বাঁচার সুযোগ করে দেব, তা নিয়ে ভাবছি না। ভোগবাদী সমাজ থেকে আমরা কেউ মুক্ত না। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকা, অথচ করোনায় সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা ওখানেই। করোনা থেকে মুক্ত হলেই কিছুদিন হয়তো একটু মেনে চলবে। এরপর আবার ভোগ-বিলাসে মেতে উঠবে সবাই। পকেটে টাকা হলেই আবার দৌড়াবে, সবকিছু ভুলে যাবে।

এমনটা ভাবছেন কেন?
বর্তমান বিশ্বের সবার টেনডেন্সি হচ্ছে, ৬ মাস কাজ করলেই বাইরে কোথাও বেড়িয়ে আসতে হবে। একটু অমুক জায়গা, তমুক জায়গা। অথচ এই আমরা ছুটি হলে নানাবাড়ি যাওয়ার বায়না ধরতাম। শীতের দিনে নানাবাড়ি গিয়ে পিঠা খাব, বৈশাখের সময় আম কুড়াব। সেই সময়টা তো আর নাই। ওসব এখন গল্প মনে হয়। সবকিছু বাণিজ্যনির্ভর, ভোগবাদী মানসিকতার হয়ে গেছে।

কিন্তু বাণিজ্যনির্ভর তো থাকতে হবে নাকি?
বাণিজ্যিক হওয়া আর বাণিজ্য মাথায় নিয়ে কাজ করার মধ্যে পার্থক্য আছে। ফিল্ম যখনই বাণিজ্যিক হতে গিয়েছে, তখন কিন্তু ধস নেমেছে। সিনেমায় কাটপিস ঢুকেছে। লাভ হয়েছে কি? ওই ধরনের বাণিজ্য করে তাহলে লাভটা কার! সিনেমা-নাটক-গান-শিল্প-থিয়েটার যা বলছে তা হচ্ছে, সত্যের অনুসন্ধান যৌক্তিক এবং মানুষের মঙ্গল। বাণিজ্যিক সিনেমায় হিরো না জিতলে আমাদের ভালো লাগে না। হিরো আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে। ভিলেন ১২-১৪ রিল দাপিয়ে বেড়ালেও ১৫-১৬ রিলে এসে মার খেতেই হবে। হিরোকে জিততে হবে। না হয় আমরা সিনেমা দেখব না। এটা তো মানুষের বেসিক ইন্সটিংক্ট। সে রকমভাবে প্রকৃতিরও কিছু বিষয় থাকে। এই যে আমরা দিনের পর দিন নদী নষ্ট করেছি।

সর্বশেষ কোন নদীর এমন দুর্দশা দেখলেন?
করোনার আগে ঢাকার বুড়িগঙ্গায় শুটিং করতে গিয়ে নাকে রুমাল দিয়ে কাজ সারতে হয়েছে। এত বিকট গন্ধ। বড় বড় কার্গো যখন যায় ছলাৎ করে পানি ওঠে, তখন মনে হয়, গা ঘিনঘিন করছে। এগুলো কি ভাইরাসের চেয়ে কম? দিনের পর দিন বুড়িগঙ্গা নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কে শোনে কার কথা! মেঘনা নদীতে শুটিং করছিলাম, এক লোক বিস্কুট খেয়ে পলিথিন ফেলল নদীতে, তাঁকে বললাম, জানেন কী ক্ষতি করছেন? কেউ কেয়ারই যেন করে না।

সমস্যাটা কোথায়?
আমাদের বেড়ে ওঠার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমাদের শিক্ষার মধ্যে সমস্যা। সুশিক্ষিত মানুষের বেশি দরকার। মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ দরকার।

বিনোদন অঙ্গন গভীর সংকটে পড়েছে...
অস্বীকার করার উপায় নেই, বিনোদন অঙ্গন গভীর সংকটে পড়েছে। এই সময়টায় আমরা নানাভাবে দেশের বিনোদনে ঘরবন্দী মানুষের মনের খোরাক দেওয়া চেষ্টা করছি। কিন্তু কতটা পারছি। আমাদের চলচ্চিত্র ও নাটকে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বলতে যা বোঝায়, তা আমরা অনেক বছর ধরে বলতে ব্যর্থ হয়েছি। মানুষের সেই স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষার বিষয় না তুলে ধরলে তো হবে না। ভাবতে হবে, কী করলে কী হবে। সত্যি এটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন আছে।