করোনাকালের থিয়েটারচর্চা যেমন

অনলাইনে চলছে ‘পেন্ডুলাম’ নাটকের মহড়া। ছবি: ফেসবুক থেকে
অনলাইনে চলছে ‘পেন্ডুলাম’ নাটকের মহড়া। ছবি: ফেসবুক থেকে

দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ শিল্পকলা একডেমির মঞ্চগুলোর ফটক। জ্বলছে না বাতি। তবে বসে নেই থিয়েটারকর্মীরা। ঘরে বসে অনলাইনেই হচ্ছে পাণ্ডুলিপি পাঠ, মহড়া, থিয়েটার প্রশিক্ষণ। তাতে দেশি মঞ্চাভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি আছে বিদেশি শিল্পীদেরও অংশগ্রহণ। তবে করোনার এই সময়ে কিংবা করোনা-পরবর্তীকালে কতটা বদলে যাবে থিয়েটা চর্চা, তা নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

করেনার এই দুঃসময়ে কিছুটা সুখবর নিয়ে আসছে ঢাকা থিয়েটার ও দেশ নাটক। দীর্ঘ তিন দশক পর দেশের মঞ্চে দেখা যাবে অভিনেতা আফজাল হোসেনকে। মাসুম রেজার রচনায় ‘পেন্ডুলাম’ নামের নাটকটি নির্দেশনা দিচ্ছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। নাটকটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘২০১৮ সালে নাটকটি লেখা শেষ হয়। মূলত তিনটি চরিত্র মঞ্চে দেখ যাবে। আমি যে ধরনের সেলিম আল দীনের নাটক করি, সে ধরনের নাটক এটি নয়। ভিন্ন আঙ্গিকের। যদিও সেলিম দ্বারা ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত মাসুম রেজা। নাটকটি একেবারেই নগর প্রেক্ষাপটে। একজন সাধারণ মানুষের বদলে যাওয়ার গল্প। পুঁজিবাদী সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে অসংগতির সময়ে বেড়ে ওঠা একজন মানুষের প্রায় শেষ বয়সে এসে তাঁর অবস্থাটা আমরা দেখার চেষ্টা করি। এক ঘণ্টার নাটক। অভিনেতা হিসেবে আফজাল আছেন। যিনি দীর্ঘ ৩০ বছর পরে সরাসরি মঞ্চে নামবেন।’
নাটকটিতে রতন চরিত্রে দেখা যাবে আফজাল হোসেনকে। আর লাসিং ও এসপ চরিত্রে দেখা যাবে নাজনীন চুমকী ও কামাল আহমেদকে। নাসির উদ্দীন ইউসুফ জানান, অনলাইনে এখন পাঠ চলছে বেলা ১১টা থেকে সোয়া ১টা পর্যন্ত। সাতটি পাঠ হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে। এরপর চরিত্রাভিনয় হবে। এই নির্দেশক বলেন, ‘আমি যে দীর্ঘ ৩০ থেকে ৩৫ বছর বর্ণনাত্মক নাটক নিয়ে কাজ করেছি, তার থেকে বেরিয়ে এসে চরিত্রাভিনয় নিয়ে কাজ করব। আমার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ অবশ্যই। কারণ, আমি তো এই ঘরানার লোক না। তবে একটা সুবিধা হচ্ছে, আমাদের মহড়াকক্ষে সময় নিয়ে যে সমস্যা হতো, সেগুলো থেকে মুক্ত হয়েছি। প্রতিদিনই দুই ঘণ্টা আউটপুট পাচ্ছি আড়াই ঘণ্টার মধ্যে। সময়টা খুব ভালোভাবে ব্যবহার হচ্ছে। সবাই খুব ফোকসড থাকে।’
নাট্যকার মাসুম রেজা বলেন, ‘যখন দেখলাম সময়টা ঘরে বসে এমনিই যাচ্ছে, তখন সেটাকে কাজে লাগানোর জন্য মহড়া করলাম অনলাইনে। আর পাঠ, চরিত্র বিশ্লেষণ, যা করছি এটা অনলাইনে বেশ ভালোই করা যাচ্ছে। আমরা আশা করছি, করোনা স্বাভাবিক হয়ে যখন দর্শক নাটক দেখতে শুরু করবেন, তখন আমরা এটাকে মঞ্চে নিয়ে আসব।’
নাটকের দল অনুস্বারও অনলাইনে করছে নতুন নাটকের মহড়া। দলের প্রশিক্ষণ সম্পাদক সাইফ সুমন জানান, আর্থার মিলারের ‘দ্য প্রাইস’ নাটকের নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ বারী ‘মূল্য ও অমূল্য’ নামে। সাইফ সুমন জানান, ইতিমধ্যে নাটকটির পাঠ ও মহড়া পেরিয়ে চলছে চিত্রায়ণও। শহীদুজ্জামান সেলিমের নির্দেশনায় ঢাকা থিয়েটার আনছে আরেকটি নাটক আনন জামানের রচনায় ‘একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার’ নামে। নির্দেশক জানান, এখন পাণ্ডুলিপি পরিমার্জনের কাজ চলছে। এরপর অনলাইনে মহড়া শুরু হবে।
এ ছাড়া আরও কয়েকটি দল অনলাইনে নাটক মহড়ার চেষ্টা করছে। কোনো কোনো দল অনলাইনে থিয়েটারবিষয়ক আড্ডা, অনলাইনে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে। নাটকের দল প্রাচ্যনাট ও বটতলা নিয়মিতই এই আয়োজন করছে। এ ছাড়া নাট্যকার মাসুম রেজা করোনাকালের ফিকশন হিসেবে ফেসবুক লাইভে করছেন ‘ছ্যাঁকা খাওয়া ছোট ভাই, পাওয়ার্ড বাই বড় ভাই’ নামে। বটতলার করোনাকালে বটতলার আলাপ কিংবা বটতলা অ্যাক্টরস স্টুডিওর অনলাইন ক্লাসে হাজির হয়েছেন আশিস বিদ্যার্থীর মতো অভিনয়শিল্পীরা।
এদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে বটতলা অনলাইনে ছাড়তে যাচ্ছে তাদের বহুল প্রশংসিত নাটক ‘ক্রাচের কর্নেল’। বটতলার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন, ‘আমরা প্রডাকশন ধরছি না। আমরা ঈদে এবার “ক্রাচের কর্নেল” ইউটিউবে প্রকাশ করছি। ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হবে। কারণ, আমরা বুঝতে পারছি না, কবে আবার মঞ্চে উঠতে পারব। এটা আমাদের চার ক্যামেরায় শ্যুট করা ছিল। বটতলার ইউটিউব চ্যানেলে ২৫ মে সন্ধ্যা সাতটায় প্রকাশিত হবে।’

ক্রাচের কর্নেল নাটকের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
ক্রাচের কর্নেল নাটকের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

তবে করোনার এই সময়ে থিয়েটার চর্চায় খানিক পরিবর্তন আসছে। বিশেষ করে অনলাইন মহড়া ও ক্লাসের কথা বলা যায়। কিংবা করোনা-পরবর্তীকালে থিয়েটার চর্চার ধরন কি পাল্টে যাবে? কী ভাবছেন থিয়েটারকর্মীরা? নাট্যজন ও নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফের কাছে এটা এক ধরনের নতুন অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, ‘করোনার পরে বেশ কিছুদিন মঞ্চে কিংবা সিনেমা হলে লোক আসবে না। কম আসবে। থিয়েটার এখনো দেখেন মধ্যবিত্ত। তারা কিছুটা ভীত, আবার বেশি সচেতন। তাহলে একটা বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে থিয়েটারকর্মীদের জন্য দর্শক নিয়ে। সে ক্ষেত্রে আমার ভাবনাটা এ রকম ছিল, দরকার হলে আমরা শিল্পকলার মাঠে ওপেন এয়ার করলাম। দর্শকদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বসার ব্যবস্থা করলাম। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আয়োজন হলো। আর আমার মনে হয় অনলাইনের যে অভিজ্ঞতা হলো এটা পারফর্মিং আর্টের জন্য একটা ভিন্ন দুয়ারও খুলে দেবে। একটা আলাদা পারফর্মিং স্পেসও তৈরি হতে পারে। কারণ, এখন মধ্যবিত্ত কিন্তু বাজার থেকে শুরু করে সবকিছু অনলাইনে করতেই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা নাটকের মহড়া করছি। কেউ কেউ টক শো করছে। এটা একটা নতুন ডিসকোর্স তৈরি হলো। সময়ের ব্যবহার অনলাইনে ভালো করা যায়। যানজট, অর্থনৈতিক সংকট যে তৈরি হয়, একজন থিয়েটারকর্মীর সেটা কিন্তু এখানে নেই। আমি জানি না আগামী দিনে কী হবে? তবে আমাদের কর্মীরা কিন্তু নতুন করে ভাবতে পারে। অনলাইন পারফরম্যান্স বলে একটা জায়গা হয় কি না। তা ছাড়া ফ্লোরে নামার আগ পর্যন্ত অনলাইনেই মহড়া হতে পারে। নতুন রিহার্সেল স্পেস বেরিয়ে গেল একটা।’
তবে করেনা-পরবর্তীকালে থিয়েটার চর্চার কি কোনো পরিবর্তন আসবে? এলে কী হতে পারে? থিয়েটারকর্মী ও নির্দেশক সাইফ সুমন বলেন, ‘যেকোনো সংকট এলে একটা উপায় বের হয়। চলতে চলতেই একটা রাস্তা বের হবে। তবে যে সংকট বেশি হবে সেটা হলো দর্শকের।’

নাটকের দল অনুস্বারও অনলাইনে করছে নতুন নাটকের মহড়া। ছবি: ফেসবুক থেকে
নাটকের দল অনুস্বারও অনলাইনে করছে নতুন নাটকের মহড়া। ছবি: ফেসবুক থেকে

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মহাসচিব কামাল বায়েজীদ বলেন, ‘মার্চ মাস থেকেই সব জায়গায় দলগুলোকে আমরা শো বন্ধ করতে বলেছি। তবে আগামী দিনে কীভাবে আমরা কাজ করব, তা এখনো চিন্তা করতে পারছি না। তবে নাট্যকর্মীদের কিংবা দলগুলোকে সাহায্য করা হচ্ছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে। কারণ, অনেক দলেরই সেট-প্রপস নষ্ট হয়ে গেছে।’
তবে নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারের কাছে সবার আগে জীবন। তারপরে থিয়েটার কিংবা বিনোদন। তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে মাথায় এখন থিয়েটার নেই। আমার শুধু চিন্তা হচ্ছে গরিব মানুষ, সাধারণ মানুষ কী করে বাঁচবে। থিয়েটার এর পরবর্তী কথা। যাঁরা এর মধ্যেও মহড়া করছেন, তাঁদের সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আমি একেবারেই থিয়েটারে মনোযোগ দিতে পারছি না। আর যেটা মনে হয়, থিয়েটার ফিরতে বেশ সময় লাগবে। বন্ধ ঘরে থিয়েটার দেখতে কজন আসবে? অন্যদিকে হয়তো লোকজন ঘরে বিরক্ত হয়ে তখন আবার নাটক দেখতে ঢুকতে পারেন। আগে জীবন, তারপরে সব।’