বিশ্ব ভালো নেই, বিশ্বজিৎ কী করে থাকে

কুমার বিশ্বজিৎ। ছবি: সংগৃহীত
কুমার বিশ্বজিৎ। ছবি: সংগৃহীত

ভালোবাসার বানে ভেসে যাওয়া যাকে বলে, শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের ক্ষেত্রে আজ সেটাই ঘটেছিল। করোনাকবলিত সময়ে প্রিয়জনের কথা কয়জনই–বা মনে রাখে। কিন্তু প্রিয় শিল্পীর জন্মদিনটি ভোলেননি অনুরাগীরা। ছবি ও শুভেচ্ছাবার্তায় তাই সয়লাব হয়ে গিয়েছিল ফেসবুক। শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ফোন করে যখন জানতে চাই, কেমন আছেন? তাঁর সে উত্তর যে কারও মন বিষণ্ন করে তুলবে, প্রিয় শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধায় আরও নত করে দেবে মাথা।

‘বিশ্ব যখন ভালো নেই, তখন বিশ্বজিৎ কী করে ভালো থাকে’, গভীর অথচ ভালোবাসায় আর্দ্র কণ্ঠে বললেন কুমার বিশ্বজিৎ। তিনি বললেন, ‘এমন দুঃসময় পৃথিবীতে আর আসেনি। এ রকম সময়ে সব উপলক্ষ গৌণ হয়ে যায়। মানুষ সামাজিক জীব, অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে দূরে থাকতে। কোলাকুলি তো আর ভার্চ্যুয়ালি হবে না। মৃত্যুতেও ছেলে বাবার কাছে, বাবা ছেলের কাছে যেতে চায় না। মানুষের নিজেকে রক্ষা করার চাপ, ভবিষ্যতের চাপ, সন্তানের পড়াশোনার চিন্তা। জীবন ও জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তার কাছে সবকিছু গৌণ হয়ে গেছে। চারপাশ থেকে কেবল বিয়োগাত্মক খবর পাই, স্বাভাবিকভাবে মন ভালো থাকে না।

গত ডিসেম্বরে মাকে হারিয়েছেন কুমার বিশ্বজিৎ। সেই শোক এখনো মন থেকে মোছেনি। মাকে ছাড়া এটাই তাঁর প্রথম জন্মদিন। স্বাভাবিকভাবেই একটা বিমর্ষ, বিষণ্ন দিন। পীড়িত স্বরে তিনি বলেন, ‘ভাবলেই বুকটা আটকে আসে, মা যদি এই সময়ে অসুস্থ হতেন, তাহলে তাঁকে হাসপাতালেও নিতে পারতাম না। এই সময়ে যাঁদের প্রিয়জন চলে গেছেন, তাঁদের আত্মার প্রতি আমার শ্রদ্ধা।’

সবকিছুর পরও জন্মদিন মানে সবচেয়ে প্রিয় দিন। জন্মদিনের প্রথম প্রহর থেকেই শুভেচ্ছাসিক্ত হচ্ছিলেন শিল্পী। রাত ১২টা এক মিনিটে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন স্ত্রী নাঈমা সুলতানা। রাত পেরিয়ে দিনেও ফোন, খুদে বার্তা আর ফেসবুকে শুভেচ্ছাসিক্ত হয়ে আনন্দিত কুমার বিশ্বজিৎ। তিনি বলেন, ‘ভার্চ্যুয়ালি যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি, তা আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। যা আমি দিইনি, তার চেয়ে বেশি পেয়েছি। জানি না ভালোবাসার এ ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব। তবে ইচ্ছা করে আরও কিছুদিন বাঁচি, আরও কিছু কাজ করি।’

ভয়াল এই সময়ে এত এত ভালোবাসা পাবেন, ভাবেননি কুমার বিশ্বজিৎ। ভেবেছিলেন, মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। হয়তো ভুলে যাবে। তাঁর ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষী ও ভক্ত-অনুরাগীরা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাঁকে। শিল্পী মনে করেন, তিনি সৌভাগ্যবান ও ঈশ্বরের ভালোবাসা পাওয়া একজন মানুষ, সে কারণেই সবাই তাঁকে মনে রেখেছেন।

স্ত্রী নাঈমা সুলতানার সঙ্গে কুমার বিশ্বজিৎ। ছবি: সংগৃহীত
স্ত্রী নাঈমা সুলতানার সঙ্গে কুমার বিশ্বজিৎ। ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কুমার বিশ্বজিৎ। গানও করেছেন সিনেমায়। বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হয়েছেন, হয়েছেন রিয়েলিটি শোয়ের বিচারক। এসব কেন করেছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হিরো হওয়ার অফারও এসেছিল আমার কাছে। বহু কষ্টে সেসব অ্যাভয়েড করেছি। বাকিগুলো অ্যাভয়েড করতে পারিনি চাপে পড়ে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে করেছি। যাঁরা করিয়েছেন, ভালোবাসা থেকেই করিয়েছেন। নিজের ট্র্যাকের বাইরে এ কাজগুলো আমি করতে চাইনি। কারণ, আমার ওসব করার গুণ নেই।’

১৯৭৭ সালের জন্মদিনটা কুমার বিশ্বজিতের কাছে আজও স্মরণীয়। ব্যান্ড গড়বেন, একটা ড্রাম সেট খুব দরকার ছিল। তখন চাইলেই সেটা ভাড়া নেওয়া বা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। সে বছর জন্মদিনে বাবা তাঁকে কিনে দিলেন ড্রাম সেট। ‘সেই আনন্দের কথা বলে বোঝানো যাবে না’, বললেন বিশ্বজিৎ।

মানুষের থেকে মানুষের দূরত্ব এঁকে দেওয়া এই মহামারিতেও কিছু মানুষ থাকছেন মানুষের পাশে। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন এই শিল্পী। বললেন, ‘এই মহামারির সম্মুখযোদ্ধা ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সামরিক বাহিনী, সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, সবার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।’

করোনায় তিনিও হাত বাড়িয়েছেন বিপদাপন্ন মানুষের দিকে। এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি এই শিল্পী। তবে এটুকুই বললেন, ‘নিজের সামর্থ্যমতো যেটা করেছি, সেটিই শেষ নয়। আমি করে যেতে চাই।’

কয়েক দিন ধরে খুব পাহাড়, নদী বা লেকের পাড়ে যেতে ইচ্ছা করছে কুমার বিশ্বজিতের। করোনা পেরোলে যাবেন নিশ্চয়ই। তারপর খোলা জায়গায় গিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেবেন।