'একজন ভালো মানুষের সংজ্ঞা মোস্তফা কামাল সৈয়দ'

মোস্তফা কামাল সৈয়দ
মোস্তফা কামাল সৈয়দ

একজন মানুষ, যাঁর সঙ্গে দেখা হলেও মনটা ভালো হয়ে যায়। তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তি টিভি ব্যক্তিত্ব সদ্যপ্রয়াত মোস্তফা কামাল সৈয়দ।

আমার সঙ্গে পরিচয় কবে হয়েছিল মনে নেই, তবে এটুকু বলতে হবে, প্রথম পরিচয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন মানুষটি। তিনি তখন বিটিভির ঊর্ধ্বতন প্রযোজক। তাঁর প্রযোজনায় একটি সাপ্তাহিক নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে অনেকটা ঘনিষ্ঠতা হয়, সেই ১৯৭৭-এ বোধ করি।

সে সময় বেশ কদিন ধরে মহড়া হতো নাটকের, মহড়ার সঙ্গে হতো জম্পেশ আড্ডা নানান বিষয়ে। আমরা হয়তো অনেকে উচ্চ স্বরে হেসেছি, কথা বলেছি, তর্ক করেছি; কিন্তু তাঁকে এসবে মাততে দেখিইনি; বরং সব সময় একটি স্মিত হাস্য দিয়ে উপভোগ করতে দেখেছি সেই আড্ডা।

নাটকটি মাথায় ভালো করে গেঁথে নিয়ে তিনি নামতেন নির্দেশনায় এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি সবকিছু করতেন। যেমন শিল্পী নির্ধারণ (এ ব্যাপারে ছিলেন খুবই খুঁতখুঁতে), সেট ডিজাইন, আবহসংগীত সংযোজন। টেলপ লেখাটা পর্যন্ত তাঁর প্রখর দৃষ্টি এড়াত না। মহড়াতে কথা কম বলতেন, কিন্তু যেটুকু বলতেন তা অত্যন্ত অর্থপূর্ণ এবং কার্যকর। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর বন্ধুসুলভ আচরণ শিল্পীদের মন দিয়ে কাজটি করতে উদ্বুদ্ধ করত ভীষণভাবে।

নাটকের রেকর্ডিংয়ের সময় দেখেছি, কোনো হুড়োহুড়ি নেই। নেই কোনো অস্থিরতা। তাঁর চিন্তাভাবনার যথার্থ প্রতিফলন না পাওয়া পর্যন্ত ঠান্ডা মাথায় শট নিয়ে যাচ্ছেন এবং সময়মতো কাজ শেষও করছেন। মূল কান্ডারি যখন নিরুদ্বেগ, তখন কর্মিবাহিনী খুবই শান্তি ও স্বস্তির সঙ্গে কাজ করে যেত তাঁর প্রযোজনায়।

ব্যক্তিগতভাবে মানুষটিকে কেউ পছন্দ না করে পারেনি বলে আমার বিশ্বাস। প্রথম সাক্ষাতেই তিনি নিজেকে এমন আন্তরিকভাবে উপস্থাপন করতেন যে আপনি তাঁর কথা মনে রাখতে বাধ্য।

আমাদের সম্পর্ক ছিল ‘ভাই’। ‘হায়াত ভাই’, ‘কামাল ভাই’। দেখা হলেই আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল: ১. কী কাজ করছেন এখন? ২. কোমরের ব্যথার খবর কী? ৩. খাওয়াদাওয়ার সিস্টেম ঠিক আছে তো?  ৪. শেষ ক্রিকেট ম্যাচটা দেখেছেন?

কামাল ভাইয়ের মতো আমিও ক্রিকেট পাগল। সাক্ষাতে এ বিষয়ের আলাপে আমরা যথেষ্ট সময় কাটিয়ে দিতাম। দ্বিতীয় বিষয় যেটা আমাদের উভয়ের জন্য জরুরি ছিল, সেটা কোমরের ব্যথা। উভয়েই যার যার নিয়ম–পন্থা শেয়ার করতাম, যাতে অপরের এই পন্থায় ব্যথা উপশম হয়।

নাটক বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ শুরু হয় সেই ১৯৯৬ সালে, যখন তিনি ডিডিজি (বিটিভি) আর আমি ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে নাটক নির্মাণ করি। আমাদের নাটকগুলো প্রচারিত হতো বিটিভিতে। তিনি প্রিভিউ করেই ফোন করতেন নিজে। খুঁটিনাটি আলাপ করতেন সেই নাটকের। কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন মনে করলে নিজেই বলে দিতেন। মনে পড়ছে, নাটকে ধূমপান ব্যাপারটা খুবই অপছন্দের ছিল তাঁর। তাঁকে আমি কখনো ধূমপান করতে দেখিনি।

টেলিভিশন ব্যবস্থাপনায় যে তিনি কতটা দক্ষ ছিলেন, তা আমরা বিটিভিতে তো দেখেইছি, পরবর্তী সময়ে এনটিভির অনুষ্ঠান, বিশেষ করে নাটক জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে তাঁর অবদান অসীম।

সংস্কৃতির চর্চা ছিল মানুষটির ধ্যানজ্ঞান। চিন্তাচেতনায় ও মননে সারাক্ষণ গিজগিজ করত সৃজনশীল সব কার্যকরণ। তাঁর হাঁটাটাও লক্ষণীয়। ওই যে, হুড়োহুড়ি বলতে কিছু নেই। মৃদু ছন্দে হাসিমুখে চলাফেরা দেখলেই বোঝা যেত, কোনো একটা কিছু নিয়ে ক্রিয়া চলছে করোটিতে। এমন একজন মানুষের রুচির কথা কি আর পৃথকভাবে বলার প্রয়োজন রাখে? পোশাকে-আশাকে একদম নিপাট ভদ্রলোক, বাহুল্য বলতে কখনো কিছু দেখিনি আমি পোশাক-পরিচ্ছদে।

মনে পড়লেও হাসি পায়, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি কড়া কড়া ভাষায় দর–কষাকষি করেছি এনটিভির সূচনালগ্নের সিরিয়াল নাটক স্বপ্নযাত্রা নির্মাণের আগে। তিনি কী সুন্দরভাবে তাঁর মিষ্টি হাসি দিয়ে সমাধান করেছেন সেসব।

আশ্চর্য, একজন মানুষ এত ভালো হয় কীভাবে! মনে পড়ে শেষ দেখাতেও হাসিমুখে একটা খোঁচা দিয়েছিলাম বোধ হয় প্রথম আলো কার্যালয়ে কয়েক মাস আগে।

একজন মানুষ এ যুগে মোবাইল ছাড়া চলে কীভাবে?

উত্তরও দিয়েছিলেন সেই চিরাচরিত স্মিত হাস্যে—কে বলল মোবাইল নেই আপনার ভাবিরটাতে ফোন করলে পাবেন আমাকে, তবে শুধু রাতে আরকি!

এহেন একজন ব্যক্তিত্বকে আপনি কী বলবেন?

আমি বলি—ভালো মানুষের সংজ্ঞা মোস্তফা কামাল সৈয়দ। এ দেশে টেলিভিশন যত দিন থাকবে, অফুরন্ত জীবনীশক্তির মানুষটির কথা ভুলতে পারবে না কেউ।‌ সালাম কামাল ভাই।

লেখক: অভিনেতা ও নির্মাতা