ভরা বৃষ্টিতে 'হঠাৎ বৃষ্টি'র বাসু চ্যাটার্জির শেষকৃত্য

বাসু চ্যাটার্জি। ছবি: ফেসবুক থেকে
বাসু চ্যাটার্জি। ছবি: ফেসবুক থেকে

চিত্রনায়ক ফেরদৌসের একটি খুদেবার্তা, ‘বাসু চ্যাটার্জি জাস্ট এক্সপায়ার্ড।’ কিছুক্ষণ পর ফোন করা হয় দেশের সিনেমার জনপ্রিয় এই চিত্রনায়ককে। কয়েকবার চেষ্টার পর পাওয়া গেল তাঁকে। ফোন ধরতেই ওপাশে কান্নার শব্দ। কথাও ঠিকমতো বলতে পারছেন না। আজ বৃহস্পতিবার সকালে কাঁদতে কাঁদতে মুঠোফোনে ফেরদৌস জানালেন, সকাল সাড়ে আটটায় মুম্বাইয়ের বাড়িতে মারা গেছেন বাসু চ্যাটার্জি।

বাসু চ্যাটার্জি পরিচালিত বাংলাদেশ ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ দিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিতি পান এই পরিচালক। আর এই ছবিতে অভিনয় করার পর বাংলাদেশ খুঁজে পায় ফোরদৌসের মতো একজন জনপ্রিয় নায়ককে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত বাসু চ্যাটার্জি ও তাঁর পরিবারের সবার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক ছিল ফেরদৌসের। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রে আমি আজ যা কিছু, পুরোটাই বাসু চ্যাটর্জির কারণেই। নয়তো আমি অন্য কোনো পেশায় থাকতাম। অন্য কোনো চাকরি করতাম। অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠা কখনোই হতো না। আমার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অবদান এই মানুষটার।’

বাসু চ্যাটার্জির মরদেহের শেষকৃত্য আনুষ্ঠানিকতা হবে মুম্বাইয়ের সান্তা ক্রুজের শ্মশানে। বেলা দেড়টায় করার কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে সম্ভব হয়নি বলে জানালেন ফেরদৌস। এই চিত্রনায়ক বললেন, ‘কী কাকতালীয় ব্যাপার! “হঠাৎ বৃষ্টি” ছবি নিয়ে কথা বলতে যেদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। আজকেও শেষকৃত্যের দিনে নাকি প্রচণ্ড বৃষ্টি।’

বাসু চ্যাটার্জির সঙ্গে ফেরদৌস ও প্রসেনজিৎ। ছবি: সংগৃহীত
বাসু চ্যাটার্জির সঙ্গে ফেরদৌস ও প্রসেনজিৎ। ছবি: সংগৃহীত

৯৩ বছর বয়সে মুম্বাইয়ে সান্তা ক্রুজ এলাকার নিজ বাড়িতে মারা গেছেন বাসু চ্যাটার্জি। সেখানকারই শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ফেরদৌস। প্রথম আলোকে ফেরদৌস বলেন, ‘বাসু দা এক বছর ধরেই অসুস্থ। কাউকে চিনতে পারতেন না, কথাও বলতে পারতেন না। ইশরায় কথা বলতেন। বড় মেয়ের চিকিৎসক স্বামীর তত্ত্বাবধানে বাসায় বরেণ্য এই পরিচালকের চিকিৎসাসেবা চলত। করোনার ঠিক আগে তাঁকে শেষ হাসপাতালে থেকে আনা হয়।’ ফেরদৌসের সঙ্গে বাসু চ্যাটার্জির শেষ দেখা হয় ২০১৯ সালের শুরুতে কলকাতায়। ফেরদৌস বললেন, ‘পরিচয়ের পর থেকে কলকাতায় যখনই আসতেন, আমাকে খবর দিতেন। আমিও ছুটে যেতাম। শেষবার যখন দেখা করি, তখন তিনি খুব একটা সুস্থ ছিলেন না। আমাকে বলছিলেন, “ফেরদৌস, আর মনে হয় এখানে আসতে পারব না। আমার সঙ্গে দেখা করতে হলে, তোমাকে মুম্বাই আসতে হবে।” সেই যাওয়া আর হলো না। এমন এক সময় মারা গেলেন, শেষ দেখাটাও সম্ভব হচ্ছে না। এই না দেখাটাই আমাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছে।’ বাসু চ্যাটার্জি ৩৫টির মতো হিন্দি ছবি পরিচালনা করেছেন। বাংলা ভাষার ছবি বানিয়েছেন ৫টি, যার মধ্যে ৪টিতে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস আর ১টিতে ভারতের প্রসেনজিৎ। ফেরদৌসকে ‘বিয়ের ফাঁদে’ শিরোনামে আরেকটি ছবির চিত্রনাট্য দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। ছবিটি পরিচালনা করার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শরীর খুব একটা ভালো না থাকায় পরিবার থেকে নিষেধ করা হয় বাসু চ্যাটার্জিকে। তারপরও ফেরদৌসকে বলেছিলেন, ‘আমি বসে বসে ডিরেকশন দিতে চাই। তোমাকে নিয়ে ছবিটা বানাতে চাই।’ তা আর হলো না। ষাটের দশকের শেষ দিকে বলিউডে ‘সারা আকাশ’ ছবিটি পরিচালনা দিয়ে বাসু চ্যাটার্জির পরিচালক অধ্যায় শুরু। বলিউডে দাপটের সঙ্গে ছবি পরিচালনা করেছেন যে কজন বাঙালি পরিচালক তাঁর মধ্যে অন্যতম বাসু চ্যাটার্জি। হিন্দির পাশাপাশি বাংলা ভাষার ছবির পরিচালনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। বাংলা ভাষায় তৈরি তাঁর ছবিগুলো হচ্ছে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’, ‘চুপিচুপি’, ‘টক ঝাল মিষ্টি’, ‘হঠাৎ সেদিন’। ‘সারা আকাশ’, ‘পিয়া কে ঘর’, ‘খাট্টা মিঠা’, ‘চক্রব্যূহ’, ‘বাতো বাতো মে’, ‘চামেলি কি শাদি’, ‘এক রুকা হুয়া ফয়সলা’, ‘জিনা ইহা’, ‘আপনে পেয়ারে’ ও ‘রজনীগন্ধা’র মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন তিনি। বলিউডের সুপারস্টারদের নিয়ে কাজ করলেও তাঁদের সম্পূর্ণ আলাদাভাবে দেখিয়েছেন তিনি। বাসু চ্যাটার্জির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘কিংবদন্তি পরিচালক, তথা চিত্রনাট্যকার বাসু চ্যাটার্জির মৃত্যুতে আমি শোকাহত। তিনি আমাদের “ছোটি সি বাত”, “চিৎচোর”, “রজনীগন্ধা”, “ব্যোমকেশ বক্সী”, “রজনী”র মতো ছবি উপহার দিয়েছেন। পরিবার, বন্ধু, অনুরাগী এবং চলচ্চিত্র জগতের সবার প্রতি রইল আমার গভীর সমবেদনা।’ পরিচালক মধুর ভন্ডারকর টুইটারে লেখেন, ‘প্রবাদপ্রতিম পরিচালকের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর সূক্ষ্ম রসবোধ এবং সহজ করে ছবির গল্প বলার ক্ষমতা সারা জীবন মনে থেকে যাবে।’ পরিচালক অশ্বিনী চৌধুরী লেখেন, ‘রেস্ট ইন পিস বাসু দা। পরিবারের প্রতি সমবেদনা।’