'মিস বাংলাদেশ' রাকার খোঁজ মিলল

প্রায় দেড় ডজন ছবিতে অভিনয় করেছেন রাকা। ছবি: সংগৃহীত
প্রায় দেড় ডজন ছবিতে অভিনয় করেছেন রাকা। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সেরা হয়েছিলেন। মঞ্চে অভিনয় করতেন। টিভিতে অভিনয় করতেন। উপস্থাপনা করতেন। করতেন মডেলিং। নেমেছিলেন সিনেমায়ও। চিত্রনায়িকা পরিচয়েই বেশি পরিচিত মাসুকা আলম রাকা। ২০১১ সালের পর আর রুপালি পর্দায় দেখা দেননি। শিল্পী সমিতির বনভোজনে শেষ তাঁকে দেখা গিয়েছিল। চলচ্চিত্র পরিবারের মানুষ হয়েও কেন দূরে সরে থাকা? উত্তরের জন্য মুখোমুখি হওয়া গেল শিল্পীর। রাকা জানালেন তাঁর বর্তমান অবস্থানের কথা। 

মার্চ মাসের ৪ তারিখে কক্সবাজারে এসেছিলেন রাকা। তাঁর স্বামী নায়ক, প্রযোজক, পরিচালক ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের গ্রামের বাড়ি উখিয়ায়। কলাতলী সৈকতে ২০০৯ সালে একটি রিসোর্ট করেন ওস্তাদ। ঢাকায় তাঁর ব্যস্ততার কারণে এই রিসোর্টর পুরোপুরি দেখভাল করেন রাকা। রিসোর্টের সংস্কারকাজ করার প্রয়োজন পড়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে সন্তানদের পরীক্ষাও শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরিবার নিয়ে রাকা চলে এসেছিলেন রিসোর্টে। আর এসেই লকডাউনের কবলে পড়লেন।


রাকা বললেন, ‘রিসোর্টে আরও ১৫/২০ দিনের কাজ বাকি আছে আমার। তারপর সবাই ঢাকায় ফিরব।’ রাকা স্বামী-সন্তানের সঙ্গে থাকেন ঢাকার কলাবাগানে। তাঁর দুই ছেলে। বড় ছেলে তানজোয়ার আলম তাজ পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। ছোট ছেলে রেজোয়ান আলম রাজ পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ২০০১ সালে ভালোবেসে সহশিল্পী ওস্তাদ জাহাঙ্গীরকে বিয়ে করেন রাকা। বিয়ের পর কিছুদিন মিডিয়াতে সময় দেন। ২০০৫ সাল থেকে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তাঁর অভিনীত শেষ ছবি কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘পিতা পুত্রের গল্প’।


রাকা বললেন, ‘সন্তান হওয়ার পর পরিবারে সময় দেওয়া দরকার হয়ে পড়েছিল। কোনো অভিমানে মিডিয়া থেকে দূরে যাইনি। আমার তেমন আক্ষেপও নেই যে নিয়মিত কাজ করতে পারিনি। আমার ইচ্ছা আছে পরিচালনায় আসার। আমাদের প্রযোজনা সংস্থা থেকে অনেক ছবি নির্মিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। নতুন দিনের মতো করেই ছবি বানাতে হবে। এখনো দেখা হলে অনেকে জানতে চান, অভিনয় ছাড়লাম কেন। তাদের বলি, শিগগিরই ফিরব।’

পরিবারের জন্য মিডিয়া থেকে দূরে রাকা। ছবি: সংগৃহীত
পরিবারের জন্য মিডিয়া থেকে দূরে রাকা। ছবি: সংগৃহীত

রাকার বাবা আবদুল মান্নান ছিলেন নবকুমার ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ। তিনি ছিলেন শিক্ষকনেতা। তাঁর মা কামরুন্নাহার মান্নান লেখালেখি করতেন। তিনিই মেয়েকে অভিনয়, নাচ, আবৃত্তি শিখিয়েছেন। তখন রাকা কলেজের ছাত্রী। পত্রিকায় মঞ্চকর্মী আহ্বানের বিজ্ঞাপন দেখে মেয়েকে নিয়ে অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদের কাছে যান মা। রাকার বাবার পরিচয় পেয়ে মমতাজউদদীন জানান, আবদুল মান্নান তাঁর বন্ধু। তখনই রাকাকে একটি চরিত্র দিয়ে দেন। পরদিন তাঁর শো। নাটকের নাম ছিল ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’।


ছয়-সাত বছর ‘থিয়েটার’ করেছেন রাকা। ‘রূপবান’, ‘রাক্ষুসী’, ‘চন্দ্রাবতী’ প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করেছেন। তখন তিনি আবৃত্তি করতেন। কামরুল হাসান রঞ্জুর সঙ্গে তাঁর ডুয়েট অ্যালবাম ‘দুজনে মিলে কবিতা’ বেরিয়েছিল ১৯৯৩ সালের বইমেলায়। প্রযোজক আহসান হাবীবের আমন্ত্রণে রাকা বিশেষ অডিশন দিয়ে ঢোকেন বিটিভিতে। তাঁরই সঙ্গে অডিশন দেন আফসানা মিমি, ত্রপা মজুমদারেরা। বিটিভির নাটকে অভিনয় করেছেন রাকা।


তাঁর অভিনীত ধারাবাহিকের সংখ্যা চারটি। এগুলো হচ্ছে ‘তথাপি’, ‘আপন নিবাস’, ‘মাটির মায়া’ ও ‘অতন্দ্র প্রহর’। এগুলোর মধ্য ‘মাটির মায়া’ নাটকে মঙ্গলী চরিত্রের জন্য বেশি সাড়া পেয়েছিলেন রাকা। তাঁর অভিনীত সাপ্তাহিক একক নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘সোনার বলয়’, ‘সেই আমরা’, ‘মন সাজিয়ে’, ‘বিচ্ছিন্ন ভালোবাসা’, ‘চাঁদনীগড়ে কয়েক দিন’, ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ প্রভৃতি। প্যাকেজ আমলে নাটক পরিচালনাও করেছেন রাকা।

দুই সন্তান ও স্বামীর সঙ্গে রাকা।
দুই সন্তান ও স্বামীর সঙ্গে রাকা।

‘সুন্দরী মিস বাংলাদেশ’ বললে এক নামে রাকাকে চিনতে পারেন দর্শক। কীভাবে ‘মিস বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন রাকা? ‘তখন আমি ইডেন কলেজে ইংরেজিতে অনার্স করছি। লন্ডনভিত্তিক লিংক প্রমোশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করে। আমি কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি পাঠিয়েছিলাম। আমি রানার্সআপ হয়েছিলাম। সাথী ইয়াসমিন হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন।’ স্মৃতি হাতড়ে বললেন রাকা। ১৯৯৫ সালে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হওয়ার পর তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে যায়।


নাটক করতে করতেই তাঁর কাছে সিনেমার প্রস্তাব আসে। কীভাবে নায়িকা হয়েছিলেন সেই গল্প বললেন রাকা, ‘“ভালোবাসবি না কেন বল” নাটকে প্রথম অভিনয় করেন ডি এ তায়েব। আমি ছিলাম এ নাটকের অভিনেত্রী। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম তখন নায়িকা খুঁজছেন। ওস্তাদ ছিলেন তায়েবের বন্ধু। ওস্তাদ তায়েবকে জানান, আমি নায়িকা হতে চাই কি না। তায়েব তাঁকে জানান যে, আমার পরিবার থেকে দেবে না। পরে তো “সুন্দরী মিস বাংলাদেশ” ছবিতে অভিনয় করলাম। এটাই আমার প্রথম ছবি।’

রিসোর্টের কাজে প্রায়ই যেতে হয় কক্সবাজার
রিসোর্টের কাজে প্রায়ই যেতে হয় কক্সবাজার

‘সুন্দরী মিস বাংলাদেশ’ মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। এরপর রাকা অভিনয় করেন প্রায় দেড় ডজন ছবিতে। এ ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কুংফু নায়ক’, ‘পেশাদার খুনী’, ‘বিদ্রোহী মাস্তান’, ‘লাল চোখ’, ‘জ্বলন্ত বিস্ফোরণ’, ‘মরণনিশান’, ‘লোহার শিকল’, ‘ক্যাপ্টেন মারুফ’ প্রভৃতি। ২০০১ সাল পর্যন্ত নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছেন। শেষের দিকে কিছু ছবিতে চরিত্রাভিনেত্রী হয়ে অভিনয় করেছেন।


সিনেমায় রাকা অ্যাকশন দৃশ্যে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তিনি মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্টধারী। বিটিভিতে ‘আত্মরক্ষায় মার্শাল আর্ট’ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে তিনি আলোচিত হয়েছিলেন। ‘ইত্যাদি’তে সহকারী উপস্থাপক হওয়া ছাড়াও শহরের নানা অনুষ্ঠানে উপস্থাপক হয়ে মাইক্রোফোন হাতে নিতেন রাকা। আবৃত্তির সঙ্গে তো জড়িত ছিলেনই। মূকাভিনয়ও করতেন। করেছেন বিজ্ঞাপনচিত্রও। ঋতুপর্ণ ঘোষের নির্দেশনায় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। কলকাতায় গিয়ে সেই বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা আজও তাঁর স্মৃতিতে উজ্জ্বল।


পারফর্মিং মিডিয়ার অনেক মাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন রাকা। এখন দূরে সরে আছেন। তাঁর সময় থেকে এখনকার সময় অনেক পাল্টে গেছে। কীভাবে এই বদলে যাওয়াটাকে দেখছেন? ‘আগে সবকিছু শিখে আসতে হতো। অনুশীলন করতে হতো। বাচনভঙ্গি ভালো না হলে কোথাও কিছু করা যেত না। সংলাপগুলো শুদ্ধ বাংলায় বলতে হতো। “আইসো”, “গেসো” বলেও এখন শিল্পী হওয়া যাচ্ছে। আর শিল্পীরও অভাব নেই। মিডিয়ার অভাব নেই। মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও কাজের অভাব হচ্ছে না। সবকিছু সুলভ হয়ে গেছে। তবে এর মধ্যেও নতুন কিছু শিল্পী ভালো করছেন’, বললেন রাকা।